মাধবপুর উপজেলা Madhabpur (হবিগঞ্জ জেলা) আয়তন: ২৯৪.২৮ বর্গ কিমি। অবস্থান: ২৩°৫৮´ থেকে ২৪°১৬´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১°১৬´ থেকে ৯১°২৫´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। সীমানা: উত্তরে লাখাই ও হবিগঞ্জ সদর উপজেলা, দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, পূর্বে চুনারুঘাট উপজেলা ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, পশ্চিমে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া সদর ও নাসিরনগর উপজেলা।
নামকরণ : কথিত হয়, মাধবপুর এলাকার প্রাচীন নাম মহাদেবপুর। হিন্দু দেবতা মহাদেব-এর নাম হতে এলাকার নাম হয় মহাদেবপুর। যা কালক্রমে পরিবর্তিত হয়ে মাধবপুর নামে স্থিতি পায়। হিন্দু আমলে এখানে মহাদেব-এর একটি মন্দির ছিল। এ মন্দিরকে ঘিরে যে পুর বা লোকালয় গড়ে উঠে তার নাম হয় মহাদেবপুর>মাধবপুর। আবার অনেকে মনে করেন, মহাদেব নামক এক সন্ন্যাসী হতে এলাকার নাম হয় মহাদেবপুর। প্রচলিত বিশ্বাস মতে, এক সময় এখানে মহাদেব সাহা নামে এক সন্ন্যাসী বাস করতেন। এ সন্ন্যাসীর প্রচুর শিষ্য ছিল । তারা এলাকাটির নাম দেন মহাদেবপুর । যার অপভ্রংশ মাধবপুর ।
তেলিয়াপাড়ায় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম বৈঠক : হবিগঞ্জের (তৎকালীন মহকুমা) তেলিয়াপাড়ায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনের পর মুক্তিযুদ্ধ সাংগঠনিক রূপ লাভ করে। ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ম্যানেজারের ডাকবাংলোতে অনুষ্ঠিত সম্মেলন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সম্মেলনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক রূপরেখা নির্ণয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক ভিত রচিত হয়েছিল। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী, লে. কর্নেল (অব.) এম এ রব, মেজর (অব.) কাজী নুরুজ্জামান, লে. কর্নেল এস এম রেজা, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর কে এম সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরি, মেজর নুরুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা। তা ছাড়াও ভারতীয় বিএসএফ প্রধান রুস্তমজি, ব্রিগেডিয়ার বি সি পান্ডে, আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সায়গল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিদ্রোহী মহকুমা প্রশাসক কাজী রকিব উদ্দিন এই সম্মেলনে যোগদান করেন। সম্মেলনে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, একটি কেন্দ্রীয় কমান্ডের অধীনে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হবে এবং এজন্য বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ ঘোষণাকারী ও প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাহিনীগুলোকে সমন্বয়সাধনের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই কার্যক্রম সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানীকে। সম্মেলনে সীমান্ত অতিক্রমকারী রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে একটি গণ প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠনের প্রস্তাব করা হয়। সম্মেলনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সমগ্র বাংলাদেশকে ৪টি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করে প্রত্যেক অঞ্চলের জন্য অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। প্রাথমিকভাবে সিলেট অঞ্চলের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন মেজর কে এম সফিউল্লাহ। তাজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী সম্মেলনে উপস্থিত সকলকে অবহিত করেন। ১৬ ১৭ এপ্রিল বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার বাস্তবায়ন ঘটে। মেজর কে এম সফিউল্লাহ এই এলাকার দায়িত্ব গ্রহণ করেই যুদ্ধক্ষেত্রে গেরিলা পদ্ধতিতে অপারেশন পরিচালনার পরিকল্পনা করেন এবং তখন থেকেই শুরু হয় হবিগঞ্জ এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ যুদ্ধ।
মাধবপুরের অ্যামবুশ
১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল মাধবপুর দখল করার পূর্বেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী শেরপুর- সাদিপুর লাইনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণে সক্ষম হয়েছিল বলে সিলেটগামী মহাসড়কে তাদের চলাচল অনেকটাই নির্বিঘ্ন ছিল। পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধারা এই মহাসড়কের সেতুগুলো ধ্বংস করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যানবাহন চলাচলে বাধা সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। এসব বিধ্বস্ত সেতুর ওপর মাটি ফেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যান চলাচলের উপযোগী করে তোলে। কিন্তু এই সড়ক পথে তাদের সৈন্য ও সামরিক যানবাহন চলাচল বাধাগ্রস্ত করতে অতর্কিত আক্রমণের নির্দেশ দেন সেক্টর অধিনায়ক মেজর সফিউল্লাহ। এই অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করা হয় ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লে. মোর্শেদকে। তিনি মাধবপুরের একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত সেতুর বিকল্প রাস্তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি কনভয়ের উপর অ্যামবুশ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। লে. মোর্শেদ ২৩ মে দুপুর ২টায় ১২জন সহযোদ্ধাকে নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছেন।পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য চলাচলের রাস্তায় তাঁরা ২টি ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন স্থাপন করে তাদের আগমনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। উল্লেখ্য, এই অ্যামবুশেই মুক্তিযোদ্ধারা প্রথম বারের মতো ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন ব্যবহার করেন।
লে. মোর্শেদ তাঁর দল নিয়ে গোপনে অ্যামবুশ স্থলের কাছে উপস্থিত হন। কনভয়ের সামনের একটি জিপ বিকল্প রাস্তার দিকে মোড় নেওয়ার সময়ই পেতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে জিপটি উড়ে গিয়ে রাস্তার বাইরে পতিত হয়। একইভাবে আরেকটি জিপ বিস্ফোরিত হলে কনভয়টি থেমে যায়। এই সময় মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ অবস্থানে থেকে একসঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর গুলি বর্ষণ করতে থাকেন। এতে অনেক পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়। অপারেশন শেষে লে. মোর্শেদ তাঁর দল নিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে নিরাপদ দূরত্বে সরে আসেন। পাকিস্তানি সৈন্যরাও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে লক্ষ্য করে প্রায় ২ কিলোমিটার পর্যন্ত পিছু ধাওয়া করে। নিকটবর্তী গ্রামে আরও মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করছে সন্দেহে প্রায় ৩০০জন পাকিস্তানি সৈন্য গ্রামটি অবরোধ করে হত্যা ও নির্যাতন চালায়। এই অ্যামবুশে প্রশিক্ষিত বেশ কয়েকজন ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন এবং অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দেন। তাঁদের মধ্যে সাদেক, ওয়াকার, ফজলে হোসেন, সাদী, সেলিম, সালাম ও আনিস পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন।
মনতলা এলাকার যুদ্ধ
মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পর্যায়ক্রমে মাধবপুর থেকে পশ্চাদপসরণ করে তেলিয়াপাড়া, মনতলা ও হরষপুর অঞ্চলে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। ১৯ মে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তেলিয়াপাড়া দখল করে। তাদের পরবর্তী লক্ষ্যস্থল ছিল মুক্তিবাহিনীর সর্বশেষ অবস্থান মনতলা, কেননা সড়ক ও রেলপথে সিলেট যাওয়ার ক্ষেত্রে মনতলা ছিল মধ্যবর্তী অবস্থানে, যার নিয়ন্ত্রণ তখন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকা ও কুমিল্লার সাথে সিলেটের যোগাযোগ পথকে নির্বিঘ্ন করতে মনতলা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে হটানো ছাড়া তাদের কোনো বিকল্প ছিল না। তাই তারা যে- কোনো মূল্যে এই স্থানটি দখলের পরিকল্পনা করে। মুক্তিযোদ্ধারাও স্থানটি দখলে রাখার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। ৩ সপ্তাহব্যাপী পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিক্ষিপ্ত আক্রমণের মাধ্যমে মনতলা দখলের প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু প্রচলিত পদ্ধতিতে আক্রমণে তাদের অনেক সৈন্য হতাহত হওয়ায় তারা যুদ্ধ কৌশলে পরিবর্তন আনে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৭ পদাতিক ব্রিগেড মনতলা এলাকা দখল করার জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করে। তারা আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও মাধবপুরে মোতায়েন ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স ব্যাটালিয়ন, ৩৩ বালুচ রেজিমেন্ট, ৯৮ মুজাহিদ ব্যাটালিয়ন ও ২১ আজাদ কাশ্মীরের একটি কোম্পানি, একটি আর্টিলারি ব্যাটারি, একটি মর্টার ব্যাটারি ও একটি কমান্ডো প্ল্যাটুনকে মনতলা যুদ্ধে নিয়োগ করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরিখা খননের মাধ্যমে মনতলার দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য ১৫ জুন থেকে রাতের আঁধারে আর্টিলারির গোলা বর্ষণ করে মনতলার আশপাশের গ্রামবাসীদের এলাকা ত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য করে। তা ছাড়া তাদের আর্টিলারি কামানগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের মর্টারের রেঞ্জের বাইরে থাকায় তাঁদের মর্টার ফায়ারে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অগ্রগতি ব্যাহত হলেও তা যথেষ্ট ছিল না। তা ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ গোলাবারুদও ছিল না। সীমিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়েই তাঁরা পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকেন। এভাবেই অতিক্রান্ত হয় ৫ দিন।
২০ জুনের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরিখা খনন করে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের কাছাকাছি চলে আসে। পাশাপাশি মুক্তিবাহিনীর অবস্থান জানার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী আকাশপথে রেকির ব্যবস্থা করে। তাদের হেলিকপ্টারগুলো নীচ দিয়ে উড়ে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানগুলোর ছবি তোলে। এদিকে ৫ দিন ধরে একটানা যুদ্ধ করে ক্যাপ্টেন নাসিমের কোম্পানি মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। তাঁর কোম্পানির শক্তিবৃদ্ধির অনুরোধের প্রেক্ষিতে ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানি থেকে একটি প্লাটুন ২০ জুন রাতে ক্যাপ্টেন নাসিমের কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয়।
২১ জুন সকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ৪টি ব্যাটালিয়নের সমন্বয়ে তিন দিক থেকে মনতলায় মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ চালায়। সেইসঙ্গে চলছিল হেলিকপ্টার পর্যবেক্ষণের সাহায্য নিয়ে অব্যর্থ নিশানায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আর্টিলারি গোলা বর্ষণ। ইতোমধ্যে অগ্রসরমান ২টি ব্যাটালিয়ন আক্রমণ চালায় ক্যাপটেন নাসিমের কোম্পানির অবস্থানের ওপর। বিপুল পরিমাণ সৈন্য ও চতুর্মুখী আক্রমণের কারণে ক্যাপ্টেন নাসিমের পক্ষে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় মেজর সফিউল্লাহর নির্দেশে ক্যাপ্টেন নাসিম তাঁর কোম্পানি নিয়ে মনতলার অবস্থান ছেড়ে কয়েক মাইল পিছনে সরে গিয়ে ভারতের পঞ্চবটিতে অবস্থান গ্রহণ করেন। এদিকে পশ্চিম দিকের চান্দুরা থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন ক্ষিপ্রগতিতে ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়ার অবস্থানে আক্রমণ চালিয়ে তাঁর অবস্থানকে বিধ্বস্ত করে দেয়। ২০০জন পাকিস্তানি সৈন্যের বিপরীতে তাঁর সৈন্য সংখ্যা তখন মাত্র ৮০জন। ১টি ভারী মেশিনগান, ৯টি হালকা মেশিনগান ও কিছু রাইফেল নিয়ে তাঁর সৈন্যরা মরণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যান। ডান দিক থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আর্টিলারির গোলা বর্ষণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এই পরিস্থিতিতে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যান্য অবস্থান এমনকি সদর দপ্তরের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। অবশেষে রাত ১০টায় ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভুঁইয়া তাঁর প্রতিরক্ষা অবস্থান ত্যাগ করে চৌমুহনিতে অবস্থান গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন এবং লোক মারফত এই সংবাদটি তিনি বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত সহযোদ্ধাদেরকে জানিয়ে দেন। দক্ষিণ-পশ্চিমের মুকুন্দপুর থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন লে. মোর্শেদের অবস্থানে আক্রমণ চালায়। ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়ার কোম্পানিকে আক্রমণকারী ব্যাটালিয়নটিও হরষপুরের দিকে এগিয়ে এসে লে. মোর্শেদের দলকে অবরুদ্ধ করে ফেলে। শুধু তাই নয়, হেলিকপ্টারের সাহায্য নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডো বাহিনী লে. মোর্শেদের কোম্পানির অবস্থানের পিছনে অবতরণ করে। লে. মোর্শেদ তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেষ্টনী ভেঙে বেরিয়ে আসার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু যুদ্ধের গতি ফেরানোর মতো পর্যাপ্ত সৈন্য তখন তাঁর কাছে ছিল না। এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য মেজর সফিউল্লাহ ক্যাপ্টেন মতিনের ২টি প্লাটুন নিয়ে পালটা আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেন। ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভুঁইয়ার কোম্পানিকে সংগঠিত করে এবং ক্যাপ্টেন মতিনের ২টি প্লাটুন নিয়ে লে. মোর্শেদের সৈন্যদেরকে বিপজ্জনক অবস্থা থেকে বের করার জন্য কলকলিয়ার দিক থেকে বেপরোয়া পালটা আক্রমণ শুরু করা হয়। এই আক্রমণে পাকিস্তানি সৈন্যরা অনেকটা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় এবং হরষপুরের একাংশ থেকে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই আক্রমণের ফলে লে. মোর্শেদের সৈন্যরা যে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার পান তা-ই নয়, বেদখল হয়ে যাওয়া কিছু এলাকাও মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। হরষপুর-মুকুন্দপুরের এই এলাকাটি ছিল প্রায় ৪০ বর্গকিলোমিটারের মতো, যা চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এলাকাটি সামরিক কৌশলগত দিক থেকে ততটা গুরুত্ব বহন না করলেও নিঃসন্দেহে পুনর্দখলের বিষয়টি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের।
স্মৃতিস্তম্ভ: তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ম্যানেজারের বাংলোর পূর্ব পার্শ্বের স্মৃতিসৌধ : স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে ২, ৩ ও ৪ নম্বর সেক্টরের শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। এর উদ্বোধন করেন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ বীর-উত্তম। চা-বাগানের ম্যানেজারের বাংলোর পূর্ব পার্শ্বে ভূমি থেকে ৫’ উঁচুতে ৫′×৫’ একটি বেদির ওপর নির্মিত হয়েছে মূল স্তম্ভটি। বেদির নীচে আছে ১.৫′ উচ্চতার একটি ১০′×৮’ প্ল্যাটফ্রম। বেদির ওপর থেকে মূল স্তম্ভটি দুই স্তরে ১৮.৫′ উঁচু আর বেড় ১০’। স্মৃতিসৌধে প্রবেশের জন্যে ২টি তোরণ রয়েছে। সামনে রয়েছে একটি স্থায়ী বক্তৃতা মঞ্চ ও ছোটো একটি পার্ক আর বাম পাশে রয়েছে একটি লেক।
মাধবপুর উপজেলা
পৌরসভা | ইউনিয়ন | মৌজা | গ্রাম | জনসংখ্যা শহর | জনসংখ্যা গ্রাম | (প্রতি বর্গ কিমি) |
১ | ১১ | ১৮১ | ২৬৮ | ১৮৮০২ | ২৫৩৭৭৬ | ৯২৬ |
মাধবপুর উপজেলার শহর
আয়তন (বর্গকিমি) | মৌজা | লোকসংখ্যা | ঘনত্ব(প্রতি বর্গ কিমি) | শিক্ষার হার |
১.৩১ | ২ | ২১৫৬ | ১৬৪৬ | ৭১.৪১ |
মাধবপুর উপজেলার ইউনিয়ন সমূহের তথ্য
ইউনিয়নের নাম ও জিও কোড | আয়তন (একর) | পুরুষ | মহিলা | শিক্ষার হার (%) |
আদৈর ১৬ | ৩৭৭২ | ৮২৩১ | ৮০২৮ | ৩৪.২৪ |
আন্দিউরাউক ৭৭ | ৬০৫৯ | ৮৪০৩ | ৮০৫০ | ৪৯.৪৮ |
চৌমোহনী ৫১ | ৮০২৫ | ১০৫৬১ | ১৪৯৩৩ | ৪১.৬৪ |
ছাতিয়াইন ৪৩ | ৫০৭৮ | ১০৫০৯ | ১০২১৪ | ৪১.৭২ |
জগদীশপুর ৬৯ | ৫৮৭১ | ১১৯৯৮ | ১১৭৫৩ | ৪১.৫০ |
ধর্মঘর ৬০ | ৬৮২২ | ১২০৭৭ | ১২০৮৮ | ৪৪.৯০ |
নোয়াপাড়া ৮৬ | ৭৫৫০ | ১৩৩৬৫ | ১২৭৮০ | ৪১.৪২ |
বাগাসুরা ১৭ | ৫৮২২ | ১২৩৪৪ | ১১৬৬৯ | ৪২.৯৯ |
বাহারা ২৫ | ৭০৫৩ | ১৪৬১৬ | ১৪৪৩৭ | ৩৮.৪৬ |
বুল্লা ৩৪ | ৬২৫৭ | ৭৯৩১ | ৮২৮৬ | ৩৪.৩৩ |
শাহ জাহানপুর ৯৪ | ১০৪০৫ | ১৪৭৮০ | ১৪৩৭৯ | ৪২.৮৫ |
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান : মসজিদ ৪৭১, মন্দির ২৭, মাযার ৫।
উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান:
শিক্ষার হার : গড় হার ৪২.১২%; পুরুষ ৪৭.৬৭%, মহিলা ৩৬.৫২%।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৪৬, জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয় ০২ টি, উচ্চ বিদ্যালয় (সহশিক্ষা)১৮ টি, উচ্চ বিদ্যালয় (বালিকা) ০৩ টি, উচ্চ বিদ্যালয় (বালক) ০১ টি, দাখিল মাদ্রাসা ০৪ টি, কলেজ ০৩ টি, স্কুল এন্ড কলেজ ০৪ টি
উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: গোবিন্দপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় (১৮৩২), আদৈর লোকনাথ উচ্চ বিদ্যালয় (১৯১১), ছাতিয়াইন বিশ্বনাথ উচ্চ বিদ্যালয় (১৯২১), জগদীশপুর জে. সি উচ্চ বিদ্যালয় (১৯২৪), আওলিয়াবাদ আরকে উচ্চ বিদ্যালয়, হরষপুর দারুল উলুম ইসলামিয়া মাদ্রাসা।
স্বাস্থ্য : উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স : ০১ টি, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ১৬ টি
গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা : শাহজীবাজার বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র
দর্শনীয় স্থান : নওয়াপাড়া, জগদীশপুর, তেলিয়াপাড়া ও সুরমা চা বাগান।
হাটবাজার : মাধবপুর বাজার, নোয়াপাড়া বাজার, তেলিয়াপাড়া বাজার, মনতলা বাজার, জগদীশপুর বাজার ও ধর্মঘর বাজার উল্লেখযোগ্য।
প্রাকৃতিক সম্পদ : গ্যাস ও কাঁচবালু
লেখা : শাহাবুদ্দিন শুভ
তথ্য সূত্র :
১. উইকিপিডিয়া
২. জেলা তথ্য বাতায়ন
৩. বাংলাপিডিয়া
৪. সিলেটের ইতিহাস – সংগ্রহ ও সম্পাদনায় কমল চৌধুরী,দেজ পাবলিশিং, কলকাতা, জানুয়ারী ২০১২, পৃষ্ঠা ৬৯,৭০,৭১
৫. মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস, – সিলেট, লে. কর্ণেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির, বীরপ্রতীক, বাংলা একাডেমী, এপ্রিল ২০১৮ পৃষ্ঠা ৪৮,৪৯, ২৯৬,২৯৭,২৩৫, ১২৬ থেকে ১৩০
৬. সিলেট বিভাগের প্রশাসন ও ভূমি ব্যবস্থা ,মোঃ: হাফিজুর রহমান ভূঁইয়া, সেপ্টেম্বর ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ৭.,
৭. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৩, মার্চ ২০০৬, পৃষ্ঠা ৫০-৫৫
৮. বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা হবিগঞ্জ , জুন ২০১৪, বাংলা একাডেমী পৃষ্ঠা ২৫,২৬
৯. জনসংখ্যা ২০০১ সালের শুমারী অনুযায়ী, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো; মাধবপুর উপজেলার মাঠ পর্যায়ের প্রতিবেদন ২০১০।
১০. স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য: তথ্য বাতায়ন
১১.বাংলাদেশের জেলা উপজেলা ও নদ নদীর নামকরণের ইতিহাস , ড. মোহাম্মদ আমীন, শোভা প্রকাশ, ফেব্রুয়ারী ২০১৮, পৃষ্ঠা ২৭৬
১২. মাধবপুর উপজেলা মানচিত্র বাংলা পিডিয়া থেকে