লাখাই উপজেলা Lakhai ( হবিগঞ্জ জেলা ) আয়তন: ১৯৬.৫৬ বর্গ কিমি। অবস্থান: ২৪°১৩´ থেকে ২৪°২৩´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১°১০´ থেকে ৯১°২১´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। সীমানা: উত্তরে অষ্টগ্রাম ও বানিয়াচং উপজেলা, দক্ষিণে নাসিরনগর উপজেলা, পূর্বে হবিগঞ্জ সদর, মাধবপুর ও নাসিরনগর উপজেলা, পশ্চিমে অষ্টগ্রাম উপজেলা।
নামকরণ : লা ও খাই দুটি খাসিয়া শব্দের সমন্বয়ে লাখাই। লা শব্দের অর্থ নাই এবং খাই শব্দের অর্থ শেষ। সুতরাং
লাখাই শব্দের অর্থ এখানেই শেষ, অর্থাৎ আর নেই। যার পরিষ্কার অর্থ খাসিয়া রাজ্যের শেষ সীমানা। এক সময় সিলেট অঞ্চলের কিয়দংশ খাসিয়া রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আলোচ্য এলাকাটি ছিল খাসিয়াদের রাজত্বের শেষ সীমানা। তাই এর নাম হয়। লাখাই। অনেকের মতে, খাসিয়া বাসায় লাখাই বলতে সীমান্ত বুঝানো হতো। এলাকাটি খাসিয়া রাজ্যের সীমান্ত বা শেষ এলাকা ছিল। তাই নাম লাখাই ।
উপজেলার পটভূমি : ভারত বর্ষের আসাম বেঙ্গল প্রদেশের শেষ সীমানায় ছিল এই অঞ্চল । বর্তমানে লাখাই ইউনিয়নের স্বজনগ্রাম নামক স্থানে ছিল লাখাই আউটপোষ্ট । ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি তৎকালীন আসাম প্রাদেশিক সরকারের গেজেট নোটিফিকেশন নম্বর ১৭৬ জিকে-র মাধ্যমে লাখাই থানা প্রতিষ্ঠিত হয় মর্মে জানা যায় । তার আগে এ অঞ্চলের সাব রেজিষ্ট্রি অফিস ছিল মাধবপুর উপজেলার চর ভাঙ্গা নামক স্থানে । ১৯৪৭ এর পরে এ অঞ্চলের সাব রেজিস্ট্রি অফিস হয় হবিগঞ্জ মহকুমায় । ৪৭ এর পরে হবিগঞ্জ মহকুমার অধীনে এ অঞ্চলকে সার্কেল অফিসার রাজস্বের আওতায় আনা হয় । ১৯৬৪ সালে এ অঞ্চলকে সার্কেল অফিসার উন্নয়নের আওতায় আনা হয় এবং স্বজনগ্রাম নামক স্থানে সিও ডেভেলপমেন্ট লাখাই এর কার্যালয় স্থাপন করা হয় । সিও ডেভেলপমেন্ট এর কার্যালয়ের অধীনে অন্যান্য অফিস স্থাপন করা হয় । ১৯৮৩ সালে বিভিন্ন লোকের দরখাস্ত এবং বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের আবেদনের প্রেক্ষিতে লাখাইকে মনোনীত থানায় উন্নীত করা হয় এবং বামৈ ইউনিয়নের ভাদিকারা মৌজার কালাউক নামক স্থানে ১৯৮৩ সালের ১৫ ই এপ্রিল মানোন্নীত থানার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয় । প্রথম উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন জনাব বিবেকানন্দ পাল । পরবর্তীতে ধীরে ধীরে কালাউক নামক স্থানেই উপজেলা পরিষদের সকল অফিস, বাসভবন প্রতিষ্ঠিত হয় ।
লাখাই উপজেলা
পৌরসভা | ইউনিয়ন | মৌজা | গ্রাম | জনসংখ্যা শহর | জনসংখ্যা | গ্রাম (প্রতি বর্গ কিমি) |
– | ৬ | ৭০ | ৬৩ | ১৪২৯৬ | ১০৬৩৮১ | ৬১৪ |
লাখাই উপজেলার শহর
আয়তন (বর্গকিমি) | মৌজা | লোকসংখ্যা | ঘনত্ব(প্রতি বর্গ কিমি) | শিক্ষার হার |
১৪.৬২ | ২ | ১৪২৯৬ | ৯৭৭ | ২৬.১৬ |
লাখাই উপজেলার ইউনিয়ন সমূহের তথ্য
ইউনিয়নের নাম ও জিও কোড | আয়তন (একর) | পুরুষ | মহিলা | শিক্ষার হার (%) |
করাব ৪০ | ৬৯৪২ | ৯১৬৯ | ৮৮১১ | ২৮.৬৭ |
বামৈ ১৩ | ৭১১৩ | ১০৬৯৮ | ১১১৪৬ | ২৮.২১ |
বুল্লা ২৭ | ১২১৬৮ | ৯৫২০ | ৯২৩৬ | ৩৫.৪১ |
মুরাকরি ৬৭ | ৪২৬০ | ৯৪৮৭ | ১০৬৪৭ | ২৫.১৬ |
মুরিয়াউক ৮১ | ৪৭০৪ | ৮৭৪০ | ১০৬৬৫ | ৩০.৪৮ |
লাখাই ৫৪ | ১১৮২৫ | ১১৪০৭ | ১১১৫১ | ২৫.২৬ |
মুক্তিযুদ্ধে লাখাই থানায় গণহত্যা : হবিগঞ্জের লাখাই থানার ভাটি অঞ্চলের কৃষ্ণপুর গ্রামের অধিবাসীদেরকে বর্ষাকালে নৌকায় ও শুষ্ক মৌসুমে হেঁটে চলাচল করতে হয়। গ্রামের দক্ষিণে বলভদ্র নদী। . মুক্তিযুদ্ধকালীন লাখাই থানার পশ্চিমে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) অষ্টগ্রাম থানায় পাকিস্তানি সেনাছাউনি স্থাপিত হয়। সেখান থেকে ২০ সেপটেম্বর ভোরে ৮-১০টি নৌকা ও একটি স্পিডবোটে করে বলভদ্র নদীপথে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য কৃষ্ণপুর গ্রামে পৌঁছে নৌকা থেকে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। এলোপাথাড়ি গুলি বর্ষণের ফলে এলাকার মানুষ, গবাদি পশু মারা পড়তে থাকে। প্রায় ঘণ্টা তিনেক গুলি বর্ষণ করার পর পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকাররা গ্রামে প্রবেশ করে যাঁকে সামনে পায় তাঁকেই গুলি করে ও বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করতে থাকে। অনেক শিশুকে তারা নদীতে ছুড়ে ফেলে দেয়। গ্রামের নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশু নির্বিশেষে সবাইকেই নির্যাতন করতে থাকে তারা। এক পর্যায়ে তারা ছোটো ছোটো ৩টি দলে বিভক্ত হয়ে গ্রামের তিন দিকে অবস্থান নেয়। একটি দল ৩২জন গ্রামবাসীকে ধরে ননিগোপাল রায়ের বাড়িতে এনে জড়ো করে গুলি চালায় এবং এতে ২৮জন গ্রামবাসী শহিদ হন। মঞ্জু রায় ও বিশ্বনাথ রায় গুলিবিদ্ধ হয়ে এবং বনবিহারী রায় ও নবদ্বীপ রায় মরার ভান করে পড়ে থেকে প্রাণে বেঁচে যান । শহিদদের নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয় নি। আরেকটি দল গ্রামের চণ্ডীপুর পাড়ার ১২-১৪জনকে ধরে এনে একটি স্থানে দীর্ঘক্ষণ বসিয়ে রাখে। সুযোগ বুঝে অনেকে ধানক্ষেতের ভিতরে লুকিয়ে প্রাণরক্ষা করেন। কিন্তু ভয়ে পালাতে না পেরে এঁদের মধ্যে ৫জনকে প্রাণ দিতে হয়। শেষ দলটি গ্রামের গজাইনগর পাড়ায় অভিযান চালিয়ে বেছে বেছে বলিষ্ঠ যুবকদেরকে বন্দি করে একটি জায়গায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তাঁদের নাম জানাসম্ভব হয় নি।
এই গণহত্যার পর ধ্বংসপ্রায় কৃষ্ণপুর গ্রামে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকে অসংখ্য মৃত দেহ ও আহত লোকজন। অক্ষত অবস্থায় গ্রামের মাত্র ৮জন পুরুষ জীবিত ছিলেন। এতগুলো মৃতদেহ সৎকার করা বা আহতদেরকে চিকিৎসা প্রদানের ব্যবস্থা করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। পশু আর মানুষের মৃতদেহ ভাসছিল নদীর পানিতে। কত লাশ পানিতে ভেসে গেছে তার সংখ্যা জানা যায় নি। শিয়াল, কুকুর আর শকুনে ভক্ষণ করেছে প্রায় ১০৮টি লাশ।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান : মসজিদ ১১০, মাযার ৫, মন্দির ৫, তীর্থস্থান ২।
শিক্ষার হার : গড় হার ২৮.৭৫%; পুরুষ ৩২.৭৯%, মহিলা ২৫.০৪%।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : কলেজ ১, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১৩, প্রাথমিক বিদ্যালয় ৭০, কিন্ডার গার্টেন ১, মাদ্রাসা ২।
উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: লাখাই এসিআরসি হাইস্কুল (১৯৪৫), বাড়িশাল করাব হাইস্কুল (১৯৪৭), বামৈ হাইস্কুল (১৯৬১), করাব রাহমানিয়া মাদ্রাসা, জিগুরা তোফায়েলিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা।
সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান : লাইব্রেরি ২, সাংস্কৃতিক সংগঠন ২, অডিটোরিয়াম ১, কমিউনিটি সেন্টার ১, খেলার মাঠ ৩, ক্লাব ৯।
দর্শনীয় স্থান : অমৃত মন্দির, বায়েজিদ শাহের মাজার, শেখ ভানু শাহের মাজার
নদ-নদী : লাখাই উপজেলার বুক চিরে বয়ে চলেছে অসংখ্য ছোট নদী, খাল, শাখা নদী । খোয়াই (শাখা), সুতাং, ধলেশ্বরী, মনিখাই, সালদিঘার খাল, কলকলিয়া নদী, মেঘনা শাখা নদী (ধলেশ্বরী) এদের মধ্যে অন্যতম ।
হাওড়-বিল : নদী, খাল সমূহ বিভিন্ন হাওড় ও বিলের সাথে সংযুক্ত । বিল সমূহের মধ্যে ফিরানী বিল, সাদালিয়া বিল, বাঘাইয়া বিল, উদাজোর বিল, ঘরভাঙ্গা বিল, ঘাগটিয়া বিল, কালীবাড়ীর বেড়, গজারিয়া নদী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ।
প্রধান কৃষি ফসল : ধান, পাট, গম।
বিলুপ্ত বা বিলুপ্তপ্রায় ফসলাদি : তিল, তিসি, কাউন।
প্রধান ফল-ফলাদি : আম, কাঁঠাল, পেঁপে, নারিকেল, জাম।
হাটবাজার : হাটবাজার ১৬, মেলা ৪। লাখাই বাজার, বুল্লা বাজার ও বামৈ গরুর হাট
মেলা : কালীবাড়ি মেলা ও বুল্লা মেলা উল্লেখযোগ্য।
প্রধান রপ্তানিদ্রব্য : ধান, পাট, মাছ।
স্বাস্থ্যকেন্দ্র : উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ১, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ৬, পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র ৩, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র ১, মাতৃসদন ১, দাতব্য চিকিৎসালয় ১, পশু চিকিৎসা কেন্দ্র ২।
লেখা : শাহাবুদ্দিন শুভ
তথ্য সূত্র :
১. উইকিপিডিয়া
২. জেলা তথ্য বাতায়ন
৩. বাংলাপিডিয়া
৪. সিলেটের ইতিহাস – সংগ্রহ ও সম্পাদনায় কমল চৌধুরী,দেজ পাবলিশিং, কলকাতা, জানুয়ারী ২০১২, পৃষ্ঠা ২৬,
৫. মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস, – সিলেট, লে. কর্ণেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির, বীরপ্রতীক, বাংলা একাডেমী, এপ্রিল ২০১৮ পৃষ্ঠা ২৯৯,৩০০,
৬. সিলেট বিভাগের প্রশাসন ও ভূমি ব্যবস্থা ,মোঃ: হাফিজুর রহমান ভূঁইয়া, সেপ্টেম্বর ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ৭.,
৭. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৩, মার্চ ২০০৬, পৃষ্ঠা ২৩৮,২৩৯,
৮. বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা হবিগঞ্জ , জুন ২০১৪, বাংলা একাডেমী পৃষ্ঠা ২৬
৯. জনসংখ্যা ২০০১ সালের শুমারী অনুযায়ী, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো; লাখাই উপজেলার মাঠ পর্যায়ের প্রতিবেদন ২০১০।
১০. স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য: তথ্য বাতায়ন
১১.বাংলাদেশের জেলা উপজেলা ও নদ নদীর নামকরণের ইতিহাস , ড. মোহাম্মদ আমীন, শোভা প্রকাশ, ফেব্রুয়ারী ২০১৮, পৃষ্ঠা ২৭৬-২৭৭
১২.লাখাই উপজেলা মানচিত্র বাংলা পিডিয়া থেকে
1 thought on “লাখাই উপজেলা”