দিরাই উপজেলা Derai Upazila (সুনামগঞ্জ জেলা) আয়তন: ৪২০.৯৩ বর্গ কিমি। অবস্থান: ২৪°৩৯´ থেকে ২৪°৫৩´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১°১০´ থেকে ৯১°২৮´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। সীমানা: উত্তরে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ ও জামালগঞ্জ উপজেলা, দক্ষিণে শাল্লা, বানিয়াচং ও নবীগঞ্জ উপজেলা, পূর্বে জগন্নাথপুর উপজেলা, পশ্চিমে শাল্লা, খালিয়াজুড়ী ও জামালগঞ্জ উপজেলা।
ইতিহাস : কালনী নদীর তীরে অবস্থিত এই উপজেলার নাম দিরাই। অতীতে দিরাইয়ের নাম ছিল বাবাগঞ্জ বাজার। জিতরাম ও দ্বিদরাম নামক দু’জন প্রভাবশালী ব্যক্তি এই এলাকায় প্রথমদিকে বসবাস করতেন, তাঁদের নামের উপর ভিত্তি করে বাবাগঞ্জ বাজারের নাম “দিরাই বাজার” হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর তারিখে প্রকাশিত আসাম গেজেট নোটিফিকেশন নং-৫৯৫৪ মূলে এই উপজেলার নামকরণ করা হয় “দিরাই”।
প্রশাসন ১৯৪২ সালে দিরাই থানা গঠিত হয় এবং থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৮২ সালে।
দিরাই উপজেলা
পৌরসভা | ইউনিয়ন | মৌজা | গ্রাম | জনসংখ্যা শহর | জনসংখ্যা গ্রাম | (প্রতি বর্গ কিমি) |
১ | ৯ | ১৬৫ | ২২২ | ২৯১০৪ | ১৭৩৬৮৭ | ৭৮২ |
দিরাই পৌরসভা :
আয়তন(বর্গ কিমি) | ওয়ার্ড | মহল্লা | জনসংখ্যা | ঘনত্ব(প্রতি বর্গ কিমি) | শিক্ষার হার % |
৬.৫০ | ৯ | ২৯ | ২২৬৮০ | ৩৪৮৯ | ৫২.১১ |
দিরাই উপজেলার ইউনিয়ন সমূহের তথ্য
ইউনিয়নের নাম ও জিও কোড | আয়তন (একর) | পুরুষ | মহিলা | শিক্ষার হার (%) |
করিমপুর ৪৭ | ১০১৫৯ | ১১৯৬ | ১০০২২ | ৩৮.৫২ |
কুলঞ্জ ৫৭ | ১৩২৯৩ | ১২০০২ | ১১৪৭৯ | ৩৭.০২ |
চরনার চর ১৯ | ১০৯১৮ | ১১০২৩ | ১০২১৭ | ৩০.৫৬ |
জগদ্দল ৩৮ | ১৩০৯৭ | ১৩২৫৭ | ১২৩০২ | ৪০.১৬ |
তাড়াল ৮৫ | ৯৬০০ | ৯২৩৬ | ৮৭৮১ | ৩৩.৭৯ |
দিরাই শরমঙ্গল ২৮ | ৭৩৮৮ | ৬৬০৮ | ৬২৯৩ | ২৯.৯০ |
ভাটিপাড়া ১৭ | ৮২৯৭ | ৯১৪৩ | ৮৪৮৬ | ২৬.৬৬ |
রফিনগর ৬৬ | ১২৭৬৪ | ১০৪৪২ | ৯৫২৩ | ২৮.২১ |
রাজানগর ৭৬ | ১০৫৭৭ | ১০৪১৯ | ৯৬৮২ | ২৯.৩১ |
নদ-নদী : দিরাই উপজেলায় মোট নদ-নদীর সংখ্যা-২৪টি । তম্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-কুশিয়ারা,কালনী,পিয়াইন,মরা সুরমা,ডাহুক।
হাওড় : এছাড়াও দিরাই উপজেলা হাওড় বেষ্টিত। এখানকার উল্লেখযোগ্য হাওড়সমূহ হলো চাপতির হাওড়,বরাম হাওড়,কালিয়াকোটা
কালনী নদী : সুরমা ও কুশিয়ারার সাথে সংযোগ স্থাপনকারী যে নদীটি, সেটি কালনী নদী নামে পরিচিত। দিরাই উপজেলার কুলঞ্জ ইউনিয়নের মার্কুলী নামক স্থান থেকে কুশিয়ারার সাথে সংযোগ নিয়ে কালনী নদী উত্তরে অবস্থিত জেলার দক্ষিণ সুনামগঞ্জ ও সদর উপজেলার কিছু অংশ ঘেঁষে সুরমায় পতিত হয়েছে। তবে দিরাই উপজেলার মার্কুলী থেকে রানীগঞ্জ বাজার পর্যন্ত নদীকে মূলত কালনী বলে, আর রজনীগঞ্জথেকে সদর উপজেলার পাঁচহাত ধনপুর গ্রাম হয়ে সুরমায় পতিত হওয়া অংশকে শাখা সুরমা বলে।
প্রধান নদী: সুরমা, কুশিয়ারা ও ডাহুকা।
জলাশয় : আইনাল বিল, ততুয়া বিল, জালালদি বিল, হরিয়া বিল ও ভোগডোবা বিল উল্লেখযোগ্য।
প্রাচীন নিদর্শন ও প্রত্ন সম্পদ : শ্যামারচর আখড়া, আকিলশাহের মাযার, ল্যাংটা শাহের মাযার, ভাটিপাড়া মসজিদ, হোসেনপুর মসজিদ।
ঐতিহাসিক ঘটনাবলি : ১৯৩৮ সালে এ উপজেলায় ‘নানকার বিদ্রোহ’ সংঘটিত হয়। ১৯৭১ সালে ২৫ আগস্ট পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ে মুক্তিযোদ্ধা আজিম উল্লা, কুটি মিয়া ও গোপেন্দ্র দাস শহীদ হন এবং আব্দুল খালেক ও কোম্পানি কমান্ডার আতাউর রহমান আহত হন।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন : গণকবর ১; বধ্যভূমি ১।
তাড়ল গ্রামে অপারেশন :হাওর বেষ্টিত দিরাই থানার অন্তর্গত তাড়ল গ্রামটি কালনী নদীর তীরে অবস্থিত। ৩ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কাইয়ুমের নেতৃত্বে হবিগঞ্জে বাহুবলে সফল অপারেশনের পর ৪ ডিসেম্বর ১০ টি নৌকা যোগে টেকের ঘাট শিবিরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথে রাত হয়ে যাওয়াতে পাকিস্তানী বাহিনীর সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করে তাড়াল গ্রামে রাত যাপন করেন।
তাড়লে রাত কাঠিয়ে পরদিন ৪ ডিসেম্বর ভোর ৫ টায় কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকারে মুক্তিযোদ্ধারা নৌকাযোগে টেকের-ঘাটের দিকে যাত্রা শুরু করেন। নৌকা গুলো বাঁক ঘুরে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় আরেকটি নৌকা তাদের সামনাসামনি এসে পড়ে। প্রথমে তারা নৌকাটিকে মাছ ধরার নৌকা মনে করলেও নৌকাটির গতিবিধি পর্যালোচনা করে কিছুক্ষণের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধারা বুঝতে পারেন যে এটি পাকিস্তানী বাহিনীর টহল নৌকা। নৌকায় পাকিস্তানী বাহিনী ও রাজাকার সশস্ত্র অবস্থায় ছিল। তখন পর্যন্ত সকাল হয়নি। মুক্তিযোদ্ধারা কাল-বিলম্ব না করে নৌকাটিকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করলে ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে টহল নৌকাটি তলিয়ে যায় এবং ৫ জন পাকিস্তানী সৈন্যের সলিল সমাধি হয়। তবে রাজাকাররা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। কোন রকম ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই মুক্তিবাহিনীর দলটি নিরাপদে টেকের ঘাট শিবিরে পৌঁছে যায়।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান : মসজিদ ২৫৩, মন্দির ১৫, মাযার ৬।
শিক্ষার হার : গড় হার ৩৫.৪%; পুরুষ ৩৮.৪%, মহিলা ৩২.২%।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: দিরাই ডিগ্রি মহাবিদ্যালয় (১৯৭৯), দিরাই উচ্চ বালক বিদ্যালয় (১৯১৫), দিরাই উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় (১৯৫৮), রাজানগর কৃষ্ণচন্দ্র পাবলিক মাধ্যমিক বিদ্যালয় (১৯০৩), ফকির মোহাম্মদ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় (১৯৮৭), দিরাই আদর্শ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় (১৮০৫), দিরাই জামেয়া হাফিজিয়া হোসাইনিয়া মাদ্রাসা (১৯৭৮)।
প্রধান কৃষি ফসল : ধান, আলু, শাকসবজি।
হাটবাজার : হাটবাজার ২০, দিরাই, রাজানগর, টানাখালি, রতনগঞ্জ, ভাটিপাড়া, শ্যামারচর, বাংলাবাজার ও ধলবাজার এবং ধলের মেলা উল্লেখযোগ্য।
মেলা : মেলা ২, ধলবাজার এবং ধলের মেলা
প্রধান রপ্তানিদ্রব্য : ধান, মাছ।
স্বাস্থ্যকেন্দ্র : উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র ১, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কল্যাণ কেন্দ্র ১৩, উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র ২, ব্র্যাক পরিচালিত যক্ষ্মা হাসপাতাল ১, হীড বাংলাদেশ পরিচালিত কুষ্ঠরোগ হাসপাতাল ১, কমিউনিটি ক্লিনিক ১৫, পশু হাসপাতাল ১।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ : ১৯৭৪ ও ১৯৮৮ সালের বন্যা এবং ২০০৪ সালের সুনামিতে ফসল ও ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।
শাহ আবদুল করিমের বাড়ি : ভাটি অঞ্চলের প্রাণপুরুষ বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম। শাহ আব্দুল করিম ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামের কালনী নদীর তীরে জন্মগ্রহণ করেন। নানা অভাব-অনটন, দুঃখ-দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে ওঠা এ বাউল এক সময় সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওর এলাকা চষে বেড়িয়েছেন। আর কালে কালে মানুষের দুঃখ দুর্দশা দেখে তা নিয়ে গান রচনা করে গেছেন। এই গানে যেমন ছিল আনন্দ তেমনি ছিল জীবন সংগ্রামের প্রেরণা। আর এ কারণেই তাঁকে দেওয়া হয়েছে ‘বাউল সম্রাটের’ মর্যাদা।
অনেক অভাব অনটনের মধ্যে বেড়ে উঠলেও গানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভালবাসা। তাঁর স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি আজও অনেক মানুষ দেখতে আসে। তার প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীত বিদ্যালয় দেখে আসতে পারেন।
লেখা :শাহাবুদ্দিন শুভ
তথ্যসূত্র :
১. উইকিপিডিয়া
২. জেলা তথ্য বাতায়ন
৩. বাংলাপিডিয়া
৪. সুনামগঞ্জ জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য : আবু আলী সাজ্জাদ হোসাইন, । ডিসেম্বর ১৯৯৫, প্রকাশক এম এ রশিদ চৌধুরী, পৃষ্টা ৮, ৯
৫. বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা সুনামগঞ্জ, জুন ২০১৪, বাংলা একাডেমী পৃষ্ঠা ২৫-২৬
৬. শ্রী হট্টের ইতিবৃত্ত পূর্বাংশ – অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি, প্রকাশক – মোস্তফা সেলিম, উৎস প্রকাশন ২০১৭, পৃষ্ঠা ৪১
৭. সিলেটের ইতিহাস, সংগ্রহ ও সম্পাদনা : কমল চৌধুরী, দে’জ পাবিলিশিং, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা ২০,
৮. মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস, – সিলেট, লে. কর্ণেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির, বীরপ্রতীক, বাংলা একাডেমী, এপ্রিল ২০১৮ পৃষ্ঠা ১১৯ ,১২০
৯. সিলেট বিভাগের প্রশাসন ও ভূমি ব্যবস্থা ,মোঃ: হাফিজুর রহমান ভূঁইয়া, সেপ্টেম্বর ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ,
১০. জনসংখ্যা ২০০১ সালের শুমারী অনুযায়ী
১১. স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য: তথ্য বাতায়ন
১২. আদমশুমারি রিপোর্ট ২০০১, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো; দিরাই উপজেলার মাঠ পর্যায়ের প্রতিবেদন ২০১০।
১৩. বাংলাদেশ ভ্রমণ সঙ্গী, মোস্তাফা সেলিম, ২য় সংস্করণ ২০১৩, পৃষ্ঠা ২১৪
১৪. বাংলাদেমের স্বাধীনতা যুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৪, মার্চ ২০০৬, পৃষ্ঠা ২৩৮-২৩৯
১৫. দিরাই উপজেলার মানচিত্র বাংলা পিডিয়া থেকে
1 thought on “দিরাই উপজেলা”