সৈয়দ জগলুল পাশা :: গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ২০২০, মঙ্গলবার ঢাকায় গুলশানের একটি হোটেলে । ১৮৫ বছরের পুরনো প্রতিষ্ঠান সিলেট সরকারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় এর ঢাকাস্থ প্রাক্তন ছাত্রদের এক পূর্ণমিলনী অনুষ্ঠিত হল। ঢাকাস্থ পাইলট স্কুলের প্রায় ৮০ জন তরুণ একত্রিত হয়েছিলেন। বলতে গেলে নিজ নিজ উদ্যোগে- কেবল নাহেদ, রাহাত, নাবিল, রানা এদের ওয়াট্স আপ মেসেজ ভিত্তিক গ্রুপের কারণে। মূল উদ্দেশ্য ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ এ অনুষ্ঠিতব্য আমাদের নাড়ির জায়গায় আয়োজিত সিলেট পাইলটিয়ান পূর্ণমিলনীকে সফল করে তোলা। পাইলট স্কুলের ৬০ ব্যাচের প্রাক্তন সচিব মুবিন স্যার, ৬৪ ব্যাচের অগ্রণী ব্যাংক চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত, ৬৭ ব্যাচের কমোডর নূরুল আমিন, ৬৯ ব্যাচের ইঞ্জিনিয়ার হাবিব আহসান বাবলু ভাই, চাটাড একাউন্টেন্ট মসিহ ভাই ,ডা ওয়াদুদ , ডা খালেদ মহসিন এসেছিলেন। ৪৯ ব্যাচের সাবকে অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিত, ৪৯ ব্যাচের নাসির এ চৌধুরী, ৪৭ ব্যাচের জাতীয় অধ্যাপক বিগ্রেডিয়ার ডা. এম এ মালিক, ৬৮ ব্যাচের দেশের সেরা মেধাবী আঃ রকিব ভাই সহ অনেকে না আসতে পেরে সংহতি জানিয়েছেন।
চিকিৎসক, শিক্ষক, সেনা কর্মকর্তা, ব্যাংকার, মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানি কর্মকর্তা, চার্টার্ড একাউন্টেন্ট, সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ সবাই এসে মাধ্যমিক পর্যায়ের উষ্ণতায় পরস্পরকে আলিঙ্গন করলেন। খাবার, ফুল, উপহারের ডালির ইয়ত্তা নেই। শুধুই প্রাণের উচ্ছ্বাসের বিনিময়। লাইভ প্রচার হল। ছবির ফ্রেমে আর জায়গা হচ্ছিল না, অনুজেরা কার্পেটে বসে পড়লো। মোদ্দাকথা- কতছবি, কত কথা, কত গান আমাদের।
সিলেট সরকারী পাইলট হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৩৬ সালে গভর্নর জেনারেল অব ইন্ডিয়া লর্ড বেন্টিন্ক এর আমলে। ১৮৪১ সালে স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন ৭৪ জন। প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে ৪১ জন প্রধান শিক্ষক কাজ করেছেন। প্রথম দিকে ১৮৩৬ থেকে ১৮৬৮ মেয়াদে তিনজন ইংরেজ প্রধান শিক্ষক ছিলেন- তারা হলেন- রেভারেন্ড প্রাইজ (১৮৩৬-১৮৪১), রেভারেন্ড জোনস (১৮৪১) এবং ডব্লিও এইচ ফক্স। প্রথম ভারতীয় প্রধান শিক্ষক হন রায় সাহেব দুর্গা কুমার দাশ।
সিলেট সরকারী পাইলট স্কুলের ছাত্র ছিলেন মুক্তিযোদ্ধের প্রধান সেনাপতি বঙ্গবীর এম. এ. জি ওসমানী, সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী, স্পীকার হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী, ডা. সুন্দরী মোহন দাশ, ড. ফখরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী, জনাব আমিনুর রশিদ চৌধুরী, কূটনৈতিক ফারুক আহমদ চৌধুরী ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী ফারুক রশীদ চৌধুরী ও অভিনেতা খলিল । বিখ্যাত রবীন্দ্র গবেষক আবু সাইদ আইয়ুব উর্দু সেকশনের ছাত্র ছিলেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত, বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন, সাবেক সচিব ও জালালাবাদ এসোসিয়েশন এর সভাপতি ড. একে আব্দুল মুবিন, বীমাবিদ জনাব নাসির এ চৌধুরী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ইনাম আহমদ চৌধুরী ও মেজর জেনারেল হাসান মাসউদ চৌধুরী শিক্ষার্থী ছিলেন এখানে । অনেক শিক্ষার্থীর জীবনের ভীত রচনা করে দিয়েছেন- সন্তান সম অসীম মমত্ব আর শাসনের কঠোরতায় আমাদের জীবিত ও প্রয়াত শিক্ষকেরা। প্রধান শিক্ষক মরহুম আব্দুল ওয়াহিদ চৌধুরী, সৈয়দ আমিরুল ইসলাম, জনাব দরস আলী, জনাব রিয়াছাত আলী, জনাব আব্দুল মান্নান স্যারদের কথা আমাদের সাম্প্রতিক স্মৃতিতে রয়েছে।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সিলেটীদের ব্যাপক অবদান রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রধান সেনাপতি জেনারেল এমএজি ওসমানীসহ বহু মুক্তিযোদ্ধা বীর বিক্রম, বীর প্রতীক ও শহীদের অবদান রয়েছে সিলেট সরকারী পাইলট স্কুলের। সিলেট পাইলট স্কুলের অনেক শিক্ষার্থী বিশ্বব্যাপী তাদের কর্মে নন্দিত ও পুরুষ্কৃত হয়েছেন। বাংলাদেশে পেয়েছেন স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক ও অনেক সম্মাননা। প্রবাসী পাইলটিয়ানরা মুক্তিযুদ্ধে আর্থিক ও সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। দেশের মন্ত্রিত্ব, সংসদে প্রতিনিধিত্ব সহ সর্বস্তরে পাইলটিয়ানরা প্রতিষ্ঠিত। সিলেটের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পাইলটিয়ানরা সম্প্রীতির উদাহরণ। সিলেট সিটি কর্পোরেশন মেয়র পদ সর্বাধিক পাইলটিয়ানরা অলংকৃত করেছেন। এক্ষেত্রে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ও কামরান আহমদ প্রণিধানযোগ্য।
কথায় কথায় আরও অনেক মজার কথা জানা গেল। পাইলটিয়ানদের বিভিন্ন ব্যাচে ব্যাচে ঢাকা, সিলেট, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে ও কখনো প্রতিবছর মিলন মেলা হয়। ইতোমধ্যে হিড়িক পড়ে গেছে ফেব্রুয়ারি ২০২০ জুড়ে বিভিন্ন ব্যাচের মিলন মেলার। জানা গেল সবাই সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। আমাদের মূল অনুষ্ঠান সিলেটের আয়োজন মালায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন- সফিউল আলম নাদেল ও আমিরুল ইসলাম লিটন সহ সকল উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ। অনেক প্রয়াত ও প্রাক্তন ছাত্রদের নাম আমার জানা নেই -সেজন্যে ক্ষমা প্রার্থী।
কেউ ১৮৫ বছরের ঐতিহ্যকে ম্লান হতে দিতে চাননা। বর স্নেহের বন্ধন দৃঢ় করে উত্তর প্রজন্মের জন্য অব্যাহত ভাবে কাজ করে যেতে চান। সবাই একমত প্রতিবছর মিলন মেলা হবে সিলেট, ঢাকা ও বিভিন্ন জায়গায়। পাইলটিয়ান ডাইরেক্টরী হতে হবে। সবচেয়ে বড় প্রত্যাশার কাজ হবে আমাদের নিজেদের অর্থে গড়ে তোলা হবে ”সিলেট সরকারী পাইলট স্কুল শিক্ষার্থী ফাউন্ডেশন বা ট্রাস্ট”।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আমরা ছড়িয়ে যাব। আসন্ন শুভ মঙ্গলের আলোকে স্বপ্নচারী তরুণদের বন্ধন আরো সুদৃঢ় হবে। এই হোক আমাদের প্রত্যয়।
লেখক: এসএসসি ১৯৭০ ব্যাচের শিক্ষার্থী, সাবেক যুগ্ম সচিব, জালালাবাদ এসোসিয়েশন ঢাকার সাবেক সাধারণ সম্পাদক
লেখকের অন্য লেখা পড়তে ক্লিক করুন