কুশিয়ারা নদী (Kushiyara River) বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা “পাউবো” কর্তৃক কুশিয়ারা নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদী নং ০৭। বরাক নদী ভারতের আসাম রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের পর্বত থেকে উদ্ভূত হয়ে কিছু দূর পর্যন্ত নাগাপাহাড় ও মণিপুর রাজ্যের মধ্যে সীমারেখা রচনা করেছে। এর পর দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে কাছাড় জেলার শিলচর থেকে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে ২৪°৫৩´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯২°৩২´ দক্ষিণ দ্রাঘিমাংশ বরাবর বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অমলসিদ নামক স্থানে বরাক দুটি ধারায় বিভক্ত হয়েছে। উত্তর-পশ্চিমের ধারাটি সুরমা এবং দক্ষিণ-পশ্চিমের ধারাটি কুশিয়ারা। হবিগঞ্জ জেলার আজমিরিগঞ্জ উপজেলার মারকুলী নামক স্থানে কুশিয়ারা পুনরায় সুরমার সঙ্গে মিলিত হয়ে কালনী নাম ধারণ করে দক্ষিণ দিকে ভৈরব উপজেলার ভৈরববাজার পর্যন্ত প্রবাহিত হওয়ার পর সুরমার অপর শাখা ধনুর সঙ্গে মিলিত হয়ে মেঘনা নামে প্রবাহিত হয়েছে। মারকুলীর উজানে কুশিয়ারা কিছুটা জায়গা জুড়ে বিবিয়ানা নদী নামেও পরিচিত।
বানিয়াচংয়ের চারদিকে রয়েছে অনেক হাওয়র , বিল-ঝিল, নদ-নদী, হাওয়রের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে কুশিয়ারা, নলাই, শুটকি,রত্না, ভেরাহোমহন, শাখা বরাক, ঝিংরি ও কাটারি নদী। রত্না, খোয়াই ও কোরাঙ্গী নদী কুশিয়ারা নদীর সঙ্গে মিশেছে। কালনী কুশিয়ারা নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে আজমিরিগঞ্জের কাকাইলছেউয়ের কাছে বছিরা নদী নাম ধারণ করে। শাখা কুশিয়ারা নবীগঞ্জ শেরপুরের কাছ থেকে বানিয়াচংয়ের উত্তরের হাওরে প্রবাহিত হয়ে আজমিরিগঞ্জের কাছে কালনী- কুশিয়ারা নদীতে মিলিত হয়েছে।
মেঘনা নদীর প্রবাহের বেশিরভাগ পানি কুশিয়ারা দিয়ে প্রবাহিত হয়। কালো রঙের মায়াময় জলের স্রোত বয়ে চলা সুগভীর কুশিয়ারা দৃশ্যত এক রহস্যময় নদী। সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলা থেকে মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলাকে পৃথক করেছে এই নদী।
কুশিয়ারা এবং সুরমা নদীর উৎপত্তিস্থল অমলসিদে সুরমা নদীর তলদেশ প্রায় শুকিয়ে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে বরাকের প্রায় ৮৫% প্রবাহ কুশিয়ারা দিয়ে প্রবাহিত হয়। কুশিয়ারার মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬১ কিমি, গড় প্রস্থ ২৫০ মিটার এবং বর্ষা মৌসুমে গড় গভীরতা প্রায় ১০ মিটার। কুশিয়ারা নদী আসাম রাজ্যের পাহাড়ী এলাকা থেকে প্রচুর পানি এবং পলি বহন করে নিয়ে আসে। আবার প্রবল স্রোতের কারণে ধাবক্ষয়ের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। শেরপুরে সর্বোচ্চ ৩,৭০০ এবং সর্বনিম্ন ৩৩ কিউসেক পানি প্রবাহ পরিমাপ করা হয়েছে।

স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, কুশিয়ারা নদী এক দিন বিপুল ঐশ্বর্যে ভরপুর ছিল। শুশুক, ইলিশসহ বহু প্রজাতির মাছ এখানে খেলা করত। উত্তাল স্রোতে চলতো পাল তোলা নৌকা। লঞ্চ, স্টিমার ও মালবাহী জাহাজ চলতো সারা বছর। ঘাটে ঘাটে ছিলো নৌকার ভিড়। ছিলো কুলি-শ্রমিকদের কোলাহল। কুশিয়ারা নদীকে কেন্দ্র করে বালাগঞ্জ বাজার, শেরপুর ঘাট ও ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার ছিলো সদা কর্মতৎপর সচল নৌ-বন্দর। বিস্তীর্ণ জনপদে কুশিয়ারা নদীর সেচের পানিতে হতো চাষাবাদ। অনেক পরিবারের জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন ছিল এই কুশিয়ারা। কিন্তু এখন নদীর দিকে তাকানো যায় না। দিন দিন যেন সঙ্কীর্ণ হয়ে আসছে তার গতিপথ। অথৈ পানির পরিবর্তে কেবল কান্নার সুরই যেন ভেসে আসে কুশিয়ারার বুক থেকে। এ যেন সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহর ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসের কথা মনে করিয়ে দেয়।
যে সব উপজেলার মধ্যে দিয়ে কুশিয়ারা প্রবাহিত :
কুশিয়ারা নদী জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ, রাজনগর, মৌলভীবাজার, নবীগঞ্জ, জগন্নাথপুর, দিরাই, শাল্লা, আজমিরিগঞ্জ উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এ নদীর তীরেই ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানা অবস্থিত।
কুশিয়ারা নদীর তীরে বাজার :
মুল নদীর তীরে ভাঙ্গা বাজার , করিমগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ, মনুমুখ, শেরপুর প্রভৃতি বাজার রয়েছে।
দক্ষিণ শাখা বরাক তীরে : নবীগঞ্জ, কালিয়ার ভাঙ্গা, হবিগঞ্জ, রতনপুর, সুজাত পুর বাজুকা।
শাহাবুদ্দিন শুভ
তথ্যসূত্র :
১. শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত পূর্বাংশ, দ্বিতীয় ভাগ, প্রথম খণ্ড,দ্বিতীয় অধ্যায়, ৩৭-৩৮ অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি; প্রকাশক: মোস্তফা সেলিম; উৎস প্রকাশন, ২০০৪
২. বাংলাদেশ লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা, হবিগঞ্জ, ২৮-২৯,, বাংলা একাডেমি, জুন ২০১৪
৩. বাংলাদেশের নদীকোষ, ড. অশোক বিশ্বাস, গতিধারা, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১১, পৃষ্ঠা ১৭২, ১৭৩।
৪. বাংলাদেশের নদ নদী , ম ইনামুল হক, জুলাই ২০১৭, অনুশীলন, পৃষ্ঠা ৫৮
৫. বাংলাদেশে পানি উন্নয়ন বোর্ড ওয়েবসাইট ১০.০৯.২০১৯
৬. জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ওয়েবসাইট ১০.০৯.২০১৯
৭. বাংলাপিডিয়া
৮ . ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
1 thought on “কুশিয়ারা নদী”