স্মরণের নৈবদ্য: বন্ধুর কাছে লিখা সৈয়দ মুজতবা আলীর পত্র

সৈয়দ জগলুল পাশা :: সৈয়দ মুজতবা আলী বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য প্রতিভাধর ব্যক্তি । জন্মেছিলেন ১৯০৪ সালে ১৩ সেপ্টেম্বর, সিলেটের এক সভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। পড়াশোনা করেছেন প্রাথমিক ভাবে সিলেট সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে। তার গভীর বন্ধুত্ব ছিল জনাব সয়ফুল আলম খান এডভোকেটের সাথে। তারা দুজনে অত্যন্ত হরিহর আত্মা ছিলেন। সৈয়দ মুজতবা আলীর হাজারেরও বেশী পত্রালাপ ছিল এডভোকেট সয়ফুল আলম খান সাহেবের সাথে। ১৯২৭ সালে সিলেট এমসি কলেজের ছাত্র হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েশন পর্যায়ে জনাব খান যখন ইংরেজীতে সর্বোচ্চ নাম্বার পেলেন। তখন মুজতবা আলী আনন্দ মুখরিত হয়ে কলকাতায় বন্ধুর কনভোকেশনে এসে ড্রেসে ভাগ বসালেন। বন্ধু নিলেন গাঊন, মুজতবা আলী নিলেন হ্যাট । এমনতর গভীর ছিল তাদের বন্ধুত্ব । শুধু বন্ধুত্ব বললে এখানে কম বলা হবে। তাঁরা পরস্পরকে জড়িয়ে রেখেছিলেন হৃদয়ের আলিঙ্গনে। মুজতবা আলীর স্মৃতির উষ্ণতা তাই জনাব সয়ফুল আলম খান সাহেবের কাছে কখনো আনন্দের, কখনো বেদনার। সৈয়দ সাহেবের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাঁদের অকৃত্রিম বন্ধুত্ব অক্ষুণ্ণ ছিল। কৈশোর, যৌবন, পৌঢ়ত্ব ও বার্ধক্যের বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁদের মাঝে ঘটছে অনেক ভাবের আদান-প্রদান, মত বিনিময়, পত্র-বিনিময় ইত্যাদি। এমনি অনেক স্মৃতি এখনো তাঁজা করে বুকে আগলে রেখেছিলেন জনাব খান। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে দুজনই এসেছিলেন।


সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন শান্তি নিকেতনের প্রথম মুসলিম ছাত্র। ১৯১৯ সালে নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে কবি গুরু এসেছিলেন সিলেটে। কবি গুরুর কয়েকদিন অবস্থান কালীন সময়ে তরুণ মুজতবা আলী কবি গুরুর সান্নিধ্যে এসে উচ্চ শিক্ষার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেন। অবশেষে এটাই তাকে শান্তি নিকেতন মুখী করে তোলে । অত;পর ১৬ বছর বয়সেই ২৩ জুন ১৯২১ সালে সৈয়দ মুজতবা আলী পাড়ি জমালেন শান্তি নিকেতনে । সেখান গিয়েও বন্ধুর সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়নি।


জনাব সয়ফুল আলম খানের বয়স যখন ৮০ এর উপর ,তখন সিলেটে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন আয়োজনের কাজে তার সাথে আমার সখ্যতা গড়ে উঠে। সেই সাথে জানা হল এতসব কথা । বন্ধুর চিঠিও উপহার দেন আমায়।

ঈশান

১৯৮৩ সালে মে মাসে আমার সম্পাদিত ঈশান সাহিত্য সংখ্যায় বন্ধু সয়ফূল আলম খান সাহেবের কাছে লেখা সৈয়দ মুজতবা আলীর চিঠি আমরা ছেপে দিয়েছি। এখানে পাওয়া যাবে জনাব সৈয়দ মুজতবা আলীর ভ্রমণ সাহিত্যের বর্ণনা তরুণ বয়সের প্রেয়সীর জন্য আকুতি ও বন্ধুত্বের গভীর অনুভূতি। আমরা ইচ্ছে করেই এ চিঠির প্রাধান্য দিয়েছি। অনেকেই অবগত আছেন যে, শান্তি নিকেতনে কবি গুরুর আশ্রয়ে শুরু হয়েছিল সৈয়দ সাহেবের জীবনের এক গুরুত্ব পূর্ণ নতুন অধ্যায়।

মুজতবা আলী শান্তি নিকেতনে প্রথম যান ২৩শে জুন, ১৯২১ সালে। চিঠি খানা এর পাশাপাশি সময়ের। এখানে তাঁরা শান্তি নিকেতন যাত্রার বর্ণনা আছে। আছে অভিজ্ঞতা সংমিশ্রিত কিছু ঘটনা বর্ণনা। হয়তো তাঁর বর্ণনায়ই আমরা খুঁজে পেতে পারি দেশে-বিদেশে লিখার মত প্রস্তুতি। নিছক সাদামাটা কিন্তু ভীষণ আন্তরিক যা সৈয়দ মুজতবা আলীর স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের অপূর্ব চমক। আশাকরছি পাঠক মহলের তা ভালো লাগবে -এজন্য চিঠিখানা হুবহু পুনরায় তুলে দিলাম সৈয়দ মুজতবা আলীর জন্মদিনের নৈবদ্য হিসেবে।


আমার অনুজ সৈয়দ নাহাস পাশা ও সৈয়দ বেলাল আহমদ সিলেট থেকে প্রকাশ করত ”ঈশান” নামের সাহিত্য সংকলন। সংকলনের প্রচ্ছদ লিপি করে দিয়ে তাদের উৎসাহিত করেছিলেন শিল্পী জনাব কামরুল হাসান। নাহাসের সম্পাদিত ঈশান সাহিত্য সংকলনের ধারা এখনও অব্যাহত আছে। আমি নিজেও আমার অগ্রজ প্রতিম সুলেখক রফিকুর রহমান লজু মাঝে মাঝে সম্পাদনা করে তার প্রকাশ অব্যাহত রেখেছি।
সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনা আজ বাংলা সাহিত্যর পরম সম্পদ। এদেশে কৃতি সন্তান তিনি। তাঁকে নিয়ে আজ দেশে-বিদেশে অনেকই গর্বিত। শান্তি নিকেতনে বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে স্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশ ভবন । রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ছাত্র ও দীর্ঘদিনের বাংলা সাহিত্য সাধনার উন্নতিতে নিয়োজিত সু-সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর নামে একটি গ্যালারি বা কর্নার স্থাপনের বিষয়ে আমরা আশা করতে পারি কি?


ই, আর, লোপলাইন
পো: শান্তি নিকেতন
১৯শে আগস্ট ১৯২১ ইং.

প্রিয়তম বন্ধু,

তোমার নিকট পরপর দুইখানা চিঠি লিখিয়াছি- কিন্তু এযাবত কোন উত্তর পাই নাই। গতকল্য একখানা চিঠি পাইয়া যে কতদূর খুশী হইয়াছি তাহা কি বলিব।

এখানে দুইবার চিঠি বিলি হয়-সকালে ৭টায় একবার ও ১১ টায় যখন খাইতে বসি তখন আর একবার। তোমার চিঠি প্রায় তখনই পাইয়াছিলাম। আমার পূর্ব লিখিত চিঠি দুইখানার প্রাপ্তি সংবাদ জানাইতে দেরী করিওনা।

অদ্য সকালে ফটো হস্তগত হইয়াছে-তুমি যে কৌশলে পাঠাইয়াছ তাহার ধন্যবাদ না করিয়া থাকা যায়না। তোমার ফটোত বেশ আসিয়াছে। আমার ঠোট কিন্তু যেন কি রকম হইয়া গিয়াছে। তুমি কিরূপ? যদি আর এক কপি স্পেয়ার করিতে পারো তবে অনুগ্রহ করিয়া মাইজম ভাই সাহেবকে (সৈয়দ মুত্তুর্জা আলী)দিয়া দিও। অবশ্য তুমি তাহাকে বলিবেনা যে আমি তোমাকে দিবার জন্য বলিয়াছিলাম।

কুলাউড়া হইতে কলিকাতা পর্য্যন্ত যে কি ঝামেলা করিয়া আসিয়াছি তাহা বর্ণনাতীত। কুষ্টিয়া ষ্টেশনের (নদীয়া জেলার) ধারে আসিয়া ষ্টেশনের প্রায় তিন মাইল আগে থাকিতে আমি জানালা দিয়া মুখ বাড়াইয়াছিলাম। কি বাড়াইব অমনি ৮/- টিকিট বাক্সটির চাবিশুদ্ধ মানিব্যাগ, ও ছোট রুবাইয়াৎ খানা পড়িয়া গেলো। আমিত হতভম্ব খাইয়া গেলাম। শিকলেও টান দেওয়া যায়নাÑ যেহেতু যে জিনিষ হারাইয়াছে তাহা ৫০/- অপেক্ষা কম মূল্যের। গাড়ী আসিয়া কুষ্টিয়াতে থামিল আমি জিনিষপত্র লইয়া নামিয়া গেলাম। মাল ষ্টেশনে মাষ্টারের জিম্মায় রাখিয়া আমি টাকা কুড়াইবার জন্য গেলাম। কিন্তু পাইলামনা । অবশেষে কুষ্টিয়া শহরের একজন ধনী মুসলমান ভদ্রলোকের কাছ হইতে ৩/- কর্জ্জ করিয়া (তিনি যে বিনা পরিচয়ে কেন টাকা দিলেন বুঝিতে পারিলামনা) কলিকাতা আসিলাম। সেখানে বহু কষ্ট করিয়া মুমিত মিয়ার হোটেল খুজিয়া বাহির করিলাম। তারপরে আর বিশেষ কষ্ট হয় নাই। বিস্তৃত বর্ণনা সাক্ষাৎ হইলে পরে বলিব। পূজার ছুটি অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে। তুমি যে আমাকে কত করিয়া বলিয়াছ আমার মত বন্ধু হয়নাÑতাহা কেবল এক তরফা নহে আমিও যে কি রকম মনে করি তাহা অন্তর্যামীই জানেন।

তোমাদের ছাড়িয়া যে কী কষ্টে আছি তাহা বলিতে অক্ষম। আজ কেবল সেই বিরহাতুরা প্রণয়িনীর কথা বার বার মনে হইতেছে, “হায় যে বুকের আলিঙ্গন পথের কন্টক স্বরূপ মনে করিতাম আজ সেই দুই বুকের মধ্যে কত পাহাড়, পর্বত নদী, ঘরবাড়ী তাহা কে ভাবিত?

অবশ্য এ সমূস্ত কথা তোমার মত শত্রুকে বলিতেছি না। তোমার কাছ হইতে এখানে আসিয়া যেন আমি স্বর্গে আসিয়াছি।তোমার জন্য দু:খ করিব-ছি-আমাকে সেরকম পাত্র বুঝি পাইয়াছ।

তুমি সৈয়দ নইব আলী (নয়া সড়ক) সাহেবের নিকট হইতে “ঠহরো“ মনোহরের কাছ থেকে “আগমনী“ ও “পয়লানম্বর“ নিয়া বাসায় দিও। ক্ষিরোদ বাবুকেও বলিবে যে তাড়াতাড়ির দরুণ তাঁহার সহিত দেখা করিতে পারি নাই। তজ্জন্য যেন ক্ষমা করেন। আমার বহুবহু সালাম জানাইবে।

আমার রুমমেইট অনেক। দুইজন মহিশূরের, তাঁহাদের সহিত ইংরাজীতে কথা বলিতে হয়-বাঙলা জানেনা। ইহার মধ্যে একজন আমার ইংরাজীর প্রফেসার। একজন ত্রিবাঙ্কুরী-তাহার সহিত ও ইংরাজী কথা বলিতে হয়। দুইজন সিংহলী ভিক্ষু। তাঁহাদের একজনের সঙ্গে বাঙলা বলা যায়-অন্যজনের সহিত ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাঙলা বলা যায়। একজন ঢাকার সে লোকটা গর্বিত, তাহার সহিত খাপ খায়না। একজন সিংহলী-তাহাকে একটু সম্মানের চোখে দেখি। তিনিও মিশুক নন, একজন আর্টিষ্ট ও ভয়ঙ্কর বলিষ্ঠ। তিনি খুব কম কথা বলেন। আর একজন ইতালীয়-তিনি MA ও ইতিহাসের অধ্যাপক। গল্প-টল্প যা তাঁর সঙ্গেই হয়। তবে প্রফেসার কিনা খুব বেশী মিশা যায়না। কাজেই তুমি বুঝিতে পার বন্ধু পাওয়া (যদিও আমি চাইনা) কত শক্ত। যাক সেকথা-তবে গল্প শুজব করিবার মত লোক এখানে খুব কম।

চাপায় পড়ি আমিও কম কথা বলি। কেবল ওমর খাইয়াম না থাকায় কষ্ট হইতেছে। একখানত হারাইয়া গিয়াছে আর একখানা কি পাবে? আর একজনের কাছে মিলিবে।

তুমি আমার নিকট চিঠি লিখিও আমি, ঘন ঘন চিঠি অবশ্য লিখব-কিন্তু তোমার মত কুঁড়ের হদ্দ‘রা যে ৩১ তারিখে চিঠি লিখিয়া ৩ তারিখে পোষ্ট করেন সে গদ্দ‘ভ যে কতদূর Regular হইবে তাহা স্পষ্টই বুঝা যায়।

বিশেষ কি লিখিব-আমি একরকম ভালো আছি।
তোমার মঙ্গল সংবাদ জানাইতে ভুল করিওনা।

একান্ত তোমারই
সীতু (সৈয়দ মুজতবা আলীর ডাক নাম)

লেখক: সৈয়দ জগলুল পাশা: লেখক,অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা ও সমাজকর্মী

syedjpasha@gmail.com

About শাহাবুদ্দিন শুভ

Read All Posts By শাহাবুদ্দিন শুভ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *