মণিপুরী

মণিপুরী (The Manipuris) বাংলাদেশের অন্যতম আদিবাসী সম্প্রদায়। প্রাচীনকালের সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং এখনকার ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুর এদের আদি বাসস্থান। প্রাচীনকালে মণিপুরী সম্প্রদায় ক্যাংলেইপাক (Kangleipak), ক্যাংলেইপাং (Kangkleipung), ক্যাংলেই (Kanglei), মেইত্রাবাক (Meitrabak), মেখালি (Mekhali) প্রভৃতি নামে পরিচিত ছিল। মণিপুরীদের মেইতেই নামেও অভিহিত করা হতো। মহারাজ গরীব নেওয়াজের (১৭০৯-১৭৪৮) শাসনামলে সিলেট থেকে আগত মিশনারিগণ এই স্থানকে মহাভারতে বর্ণিত একটি স্থান মনে করে এই ভূখন্ডের নাম দেন মণিপুর। এভাবেই এখানকার প্রধান অধিবাসী মেইতেইদের নাম হয়ে যায় মণিপুরী। পরবর্তীকালে অনুসন্ধানে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এখনকার মণিপুর এবং মহাভারত-এ উল্লিখিত মণিপুর একই স্থান নয়। মণিপুরীরা বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধ, সংগ্রাম এবং অন্যান্য সামাজিক, রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশে এসে বসতি স্থাপন করে।

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তার বাংলাদেশের মণিপুরী সম্প্রদায় প্রবন্ধে লেখেন , মহাভারতে বর্ণিত আছে যে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পঞ্চপর্বত-বেষ্টিত মণিপুর রাজ্য নৃত্যগীতে পারদর্শী ‘গন্ধব’ নামে একটি জাতি বাস করত। সেই জাতির নামানুসারে সেদেশের আদিনাম ‘গন্ধর্ব রাজ্য’। একসময় ‘মেখলী’ বলেও খ্যাত ছিল। অসমীয়রা একে ‘মগলু’ এবং ব্রহ্মদেশীয়রা একে ‘কতে’ বলত।

মণিপুর নামকরণের পেছনে একটা পৌরাণিক কাহিনী আছে। একদা দেবী দুর্গা মহাদেবের প্রেমে আসক্ত হয়ে আনন্দচিত্তে লীলা ও কীর্তন করার জন্য মহাদেবকে অষ্টপর্বত পরিবেষ্টিত অরণ্যময়, কুসুমে নর্তন সুরভিত এক উপত্যকা ভূমিতে উপনীত হন। বর্তমান মণিপুর ও লোকতাক হ্রদ। মহাদেব ত্রিশূলাঘাতে পর্বত ছিদ্র করে জল বের করেন। মহাদেব ও দুর্গা আহ্লাদে লীলাখেলা করছেন এমন সময় নাগপতি অনন্ত দুর্গা ও মহাদেবকে লীলাখেলার আনন্দে বিমূঢ় দেখে সেও আনন্দে আনন্দিত হয়ে মস্তকসমূহে মণি রাজি ছড়িয়ে দেয়। মণিসমূহে উপত্যকা ভূমি উজ্জ্বলময় আলোকে আলোকিত হয়েছিল বলে ওই ভূভাগের নাম পরবর্তী সময় ‘মণিপুর’ নামে আখ্যায়িত হয়। মণিপুরের আদিবাসীদের মণিপুরী বলা হয়।

জাতিগত উৎপত্তি ঐতিহাসিকভাবে মণিপুরীদের ৭টি ইয়েক (Yek) বা সালাইস-এ (Salais) ভাগ করা হয়। এগুলি হচ্ছে: নিংথাউযা (Ningthouja), লুওয়াং (Luwang), খুমান (Khuman), মৈর্যাং (Moirang), অংঅম (Angom), চেংলেই (Chenglei) এবং খাবা-গণবা (Khaba-Nganba)। প্রতিটি ইয়েক বা সালাইসকে আবার অনেকগুলি শাগেইস-এ (Shageis) (পারিবারিক নাম) বিভক্ত করা হয়েছে। পরবর্তীকালে এসব ইয়েক বা সালাইস বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে রূপান্তরিত হয়ে পড়ে। আর এভাবেই নিংথাউযা ইয়েক হয়ে যায় শান্ডিল্য (Shandilya) গোত্র, খুমান হয় মৌদ্গল্য (Moudgalya), মৈর্যাং হয় আত্রেয় (Atreya) ও অঙ্গীরাশ্ব (Angirasya), অংঅম হয় গৌতম (Goutama), লুওয়াং হয় কাশ্যপ (Kashyapa), চেংলেই হয় বশিষ্ঠ (Bashistha) ও অঙ্গীরাশ্ব (Angirasya) এবং খাবা-গণবা থেকে হয় ভরদ্বাজ (Bharadwaj) ও নৈমিষ্য (Neimisya) সম্প্রদায়।

বাংলাদেশে বসতি স্থাপন :
বাংলাদেশে মণিপুরীদের বসতি স্থাপনের ইতিহাস প্রায় তিনশ বছরের । সিলেট বিভাগের অন্তর্গত হবিগঞ্জ জেলা ছিল প্রাচীন তরফ রাজ্য। এই তরফ রাজ্যের সাথে মণিপুরের একটি ঐতিহাসিক যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছিল অনেক আগে। মণিপুরের প্রাচীন ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি মহারাজ খাগেম্বার শাসনামলে (১৫৯৭-১৬৫২) একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে তরফ রাজ্যের সাথে প্রথম যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ঘটনাটি ১৬০৬ খ্রিষ্টাব্দের একটি সামন্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজার সাথে যুবরাজ শানোংবার মতদ্বৈধতা সৃষ্টি হলে শানোংবা অনুগত বাহিনী সহ পালিয়ে গিয়ে কাছারে আশ্রয় নেন। তার পর কাছাড় রাজের সহায়তায় মণিপুর আক্রমণ করে ব্যর্থ হন। পরে কাছাড় রাজার পরামর্শক্রমে মুসলিম শাসিত তরফ রাজ্যের সহায়তা নিয়ে মিলিত বাহিনী নিয়ে পুনরায় মণিপুর আক্রমণ করেন । আর সে কারণেই হয়তোবা মণিপুরী রাজা বন্ধি হওয়া কাছাড়ি ও তরফ মুসলিম সৈন্যদেরকে মুক্তি দিয়ে মণিপুরে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন এবং তাদের সাথে বিয়ে দেন মণিপুরী মেয়ে। মুসলিম সৈন্য ও মণিপুরী মেয়ের ঔরসজাত বংশধররাই পরবর্তীতে ‘মৈতৈ পাঙন’ বা মণিপরী মুসলিম নামে পরিচিতি। তবে সব চেয়ে ব্যাপক অভিবাসনের ঘটনা ঘটে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। ১৮১৯ থেকে ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দ এই সময়কালে ।

তবে এ ধরনের অভিবাসন প্রথম শুরু হয় (১৮১৯-১৮২৫) মণিপুর-বার্মা যুদ্ধের সময়। একটি অনুসন্ধানী গবেষণায় লক্ষ্য করা যায় যে, এই যুদ্ধের সঠিক কাল আরও আগে অষ্টাদশ শতাব্দীতে এবং রাজা ভাগ্যচন্দ্রের সময়ে (১৭৬৪-১৭৮৯) উক্ত অভিবাসন শুরু হয়। তবে মণিপুর-বার্মা যুদ্ধের সময় অভিবাসন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। এ সময় মণিপুর পরাধীন হয়ে পড়ে এবং বর্মি দখলদারগণ প্রায় ৭ বছর দেশটি শাসন করে। উক্ত সময়ে মণিপুররাজ চৌরাজিত সিংহ তাঁর দুই ভ্রাতা মারজিত সিংহ ও গাম্ভির সিংহসহ সিলেটে আশ্রয় নেন, সঙ্গে নিয়ে আসেন অনেক ধনসম্পদ। তারা সিলেটের মীর্জা জাঙ্গালে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন যার ধ্বংসাবশেষ এখনও বিদ্যমান। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, ময়মনসিংহের দুর্গাপুর এবং ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় মণিপুরী বসতিগুলি সে সময়ই গড়ে ওঠে। তবে সময়ের স্রোতে এসব বসতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বর্তমানে মণিপুরীরা বৃহত্তর সিলেটে বসবাস করছে। সিলেট শহর ও শহরতলি, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া ও বড়লেখা থানা, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট এবং সুনামগঞ্জের ছাতকে এদের বসবাস লক্ষ্য করা যায়। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে মণিপুরীদের সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। এদের মধ্যে মৌলভীবাজারে ১৩ হাজার, সিলেটে ৭ হাজার এবং হবিগঞ্জে ৪ হাজার মণিপুরী বসবাস করে। অন্যান্য আদমশুমারির উপাত্ত প্রকাশ করা হয়নি।

মণিপুরী জাতিগোষ্ঠী :
জাতিগত দিক থেকে মণিপুরীরা মঙ্গোলীয় মানবগোষ্ঠীর তিব্বতি-বর্মি পরিবারের কুকি-চীন গোত্রভুক্ত। তবে মণিপুরীদের মধ্যে আর্য ও অন্যান্য রক্তের যথেষ্ট মিশ্রণ ঘটেছে। বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থান এবং বেশ কয়েকটি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মিথস্ক্রিয়ার ফলে বহুকাল থেকে মণিপুর বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠী ও সংস্কৃতির মিলনকেন্দ্র হিসেবে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের সংমিশ্রণের ফলেই আধুনিক মেইতেই জনগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে, যাদের আজ মণিপুরী হিসেবে অভিহিত করা হয়।

মণিপুরে তিন গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের বাস- বিষ্ণুপ্রিয়া, মৈতৈ ও পাঙান।গন্ধর্বদের রাজত্বকালে মহাভারত-খ্যাত পঞ্চপাণ্ডবদের তৃতীয় ভ্রাতা অর্জুন মণিপুর রাজ্যে পরিভ্রমণে গিয়ে গন্ধর্ব রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিয়ে করেন। অর্জুনের সঙ্গে ক্ষত্রিয় যোদ্ধা যারা মণিপুর গিয়েছিল, তাদের অনেকে গন্ধর্ব কন্যাদের বিয়ে করে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। অর্জুন ও চিত্রাঙ্গদার একমাত্র ঔরসজাত সন্তান বভ্রূবাহন মণিপুরের সিংহাসনে অধিপতি হন। মণিপুরে গন্ধর্বদের পরে আর্য-ক্ষত্রিয়দের শাসন শুরু হয়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর যুধিষ্ঠির অশ্বমেধ যজ্ঞ করলে রাজা বভ্রূবাহন সেই যজ্ঞে যোগদান করতে মিথিলার রাজধানী হস্তিনায় গমন করেন। যজ্ঞ শেষে মণিপুরে ফেরার সময় বভ্রূবাহন হস্তিনার বিষ্ণুপ্রিয়া মন্দিরস্থ অনন্তশায়ী সুবর্ণ ও বিশাল বিষ্ণুমূর্তি সঙ্গে নিয়ে আসেন। বিষ্ণুবিগ্রহ স্থাপনের পর থেকে মণিপুরের রাজধানী ‘বিষ্ণুপুর’ নামে পরিচিতি লাভ করতে থাকে। অর্জুনের বংশধর ক্ষত্রিয় বংশী এবং বিষ্ণুর উপাসক বলে তাদেরকে বিষ্ণুপ্রিয়া বলা হয়।

ভাষা ও সাহিত্য :
মণিপুরীদের মাতৃভাষা মেইতেই লন বা মণিপুরী ভাষা মঙ্গোলীয় ভাষা পরিবারের তিব্বতি-বর্মি উপ-পরিবারভুক্ত এবং কুকি-চীনা দলভুক্ত। মণিপুরী ভাষা ও সাহিত্য খুবই প্রাচীন। এর রয়েছে একটি সমৃদ্ধ ও বর্ণাঢ্য ইতিহাস এবং দীর্ঘ ঐতিহ্য। মণিপুরী ভাষা আজ শুধু মণিপুরের রাষ্ট্রভাষাই নয়, এটি ভারতের সংবিধানে ৮ম তফশিলে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
মণিপুরীদের বিবাহ উৎসব

মণিপুরী সাহিত্যের প্রাচীনতম মূল্যবান নিদর্শন হচ্ছে ঔগরি (Ougri)। এটি একটি গীতিকবিতা। ৩৩ সালে মণিপুরী রাজা পাখাংবা-র (Pakhangba) সিংহাসনে আরোহণ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সূর্য দেবতার উদ্দেশে এটি গীত হয় বলে ধারণা করা হয়। তবে ৮ম শতাব্দীর একটি তামার পাত্রে পাওয়া গেছে প্রথম লিখিত সাহিত্য। এটি মহারাজা খংটেকচা-এর (Khongteckcha) সময় লেখা হয়। পরবর্তীকালে মণিপুরী সাহিত্য দ্রুত বিস্তার লাভ করছে এবং আধুনিক মণিপুরী ভাষায় লেখা অনেক সাহিত্য একাডেমী পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। অনুবাদের ক্ষেত্রেও মণিপুরীরা খুব একটা পিছিয়ে নেই। মহাভারত, রামায়ণের মতো মহাকাব্য এই ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ধর্মীয় গ্রন্থ শ্রীভগবদ্গীতা, বাইবেল প্রভৃতি মণিপুরী ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এছাড়া বিশ্বসাহিত্যের মহান লেখকদের, যেমন হোমার, সফোক্লিস, শেক্সপীয়র, টলস্টয়, বার্নাড শ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্রসহ অন্যান্যদের ধ্রুপদী লেখাসমূহ এই ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। প্রাচীন মণিপুরী হরফের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিটি হরফের নামকরণ করা হয়েছে মানবদেহের এক একটি অঙ্গের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজা গরীব নেওয়াজের শাসনামলে মণিপুরী হরফকে বাংলা হরফে প্রতিস্থাপিত করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গদেশে নবপ্রবর্তিত সনাতন চৈতন্যবাদের সঙ্গে মণিপুরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন।

সংস্কৃতি:
মণিপুরী সংস্কৃতি অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী ও ঐতিহ্যবাহী। নৃত্য ও সঙ্গীত মণিপুরীদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মণিপুরী সংস্কৃতির সবচেয়ে সমৃদ্ধ শাখা হচ্ছে মণিপুরী নৃত্য। মণিপুরী ভাষায় নৃত্যের প্রতিশব্দ হচ্ছে জাগই (Jagoi)। এই নৃত্যে শারীরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চালনার মাধ্যমে বৃত্ত বা উপবৃত্ত সৃষ্টি করা হয়। মণিপুরী সংস্কৃতির সবচেয়ে উৎকৃষ্ট নিদর্শন হচ্ছে রাসা (Rasa) নৃত্য। ভারতীয় সংস্কৃতিতে রাসার অবদান অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র রাসা নৃত্য উদ্ভাবন করেন এবং ১৭৭৯ সালের কার্তিকের পূর্ণিমায় মণিপুরে এটি প্রথম অনুষ্ঠিত হয়। নানা ধরনের মণিপুরী নৃত্য আছে; এগুলিকে প্রধানত ২টি শ্রেণীতে ভাগ করা যায় ফোক বা লোকনৃত্য ও ক্লাসিক বা ধ্রুপদী নৃত্য। লোকনৃত্যের মধ্যে রয়েছে লাইহারাওবা (Laiharaoba), খাম্বা-থইবি (Khamba-Thoibi), মেইবি-জাগই (Maibi-Jagoi), লেইশাম জাগই (Leisham Jagoi), ইত্যাদি। পক্ষান্তরে রাসা নৃত্য (Rasa) হচ্ছে গোষ্ঠা লীলা (Gostha Leela) উদূখল (Udukhol), মৃদঙ্গ (Mridanga) ইত্যাদি ধ্রুপদী শ্রেণীর নৃত্যের অন্তর্ভুক্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মণিপুরী নৃত্যকে বহির্বিশ্বে পরিচিত করান। ১৯১৯ সালে সিলেট ভ্রমণকালে তিনি প্রথম মণিপুরী নৃত্য দেখেন। কবিগুরু এই নৃত্যের গভীরতা, স্নিগ্ধতা এবং নৃত্যভঙ্গিতে নিজেকে উৎসর্গ করার বিনয়ী সংকেত দেখে অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছিলেন। অতি অল্পকাল পরেই তিনি আগরতলা থেকে রাজকুমার বুদ্ধিমনতা সিংহ-কে শান্তিনিকেতনে নিয়ে গিয়ে মণিপুরী নৃত্য প্রবর্তন করেন।
মণিপুরী নৃত্য

মণিপুরী নৃত্যকে বলা হয় লাস্য (Lashya) বা কোমল ধরনের নাচ। কোমলতা ও নম্রতা হচ্ছে এই নৃত্যের বিশেষত্ব, লাইহারাওবা-তে দেখা যায় চমৎকার রুচিশীল শারীরিক ভঙ্গিমা, সৌন্দর্য ও নিবেদনের আকুতি। মৃদঙ্গ নৃত্যেও এরকম ভাবপ্রকাশ লক্ষণীয়। আবার শ্রীকৃষ্ণ-নর্তনে ফুটে ওঠে অসীমতার প্রতি জীবনের আকুতি প্রকাশ। খাম্বা-থইবি নৃত্যে এই দুয়ের অর্থাৎ টানভা (শক্তিমত্ততা) ও লাস্যময়তার সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়।

ধর্ম ও অনুষ্ঠান :
ধর্মীয় বিচারে সকল মণিপুরী বর্তমানে চৈতন্য ধারার সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী। তবে অষ্টাদশ শতাব্দীতে সনাতন ধর্মগ্রহণের পূর্বে মণিপুরীরা অপক্পা (Apokpa) ধর্মচর্চা করত। পরবর্তীকালে যদিও সনাতন বৈষ্ণব ধর্মের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য মণিপুরীদের মন জয় করে নেয়, কিন্তু তারা তাদের পূর্বের বিশ্বাস একেবারে বির্সজন দেয়নি। ফলে এই দুই বিশ্বাসের সংশ্লেষণে তৈরি হয়েছে একটি নব ধারার যার বহিরঙ্গে চৈতন্য ধারার প্রেমাবেগ সৌন্দর্য আর অন্তরঙ্গে রয়েছে পুরানো বিশ্বাস ও অনুভূতি। মণিপুরীরা একদিকে জাঁকজমক ভাবে সনাতন ধর্মের বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি, যেমন রথযাত্রা, রাসপূর্ণিমা, ঝুলনযাত্রা ইত্যাদি পালন করে, একইসঙ্গে তারা পূর্বের ধর্মীয় অনুষ্ঠান লাইহারাওবা (Laiharaoba), সাজিবু চেইরাওবা (Sajibu Chairaoba) ইত্যাদিও পালন করে। তারা সানামাহি (Sanamahi), পাকাংবা (Pakangba) এবং লেইমারেন (Leimaren) প্রভৃতি গৃহ দেবদেবীর পূজাও করে থাকে। এছাড়া অনেক মণিপুরী আছে যারা একইসঙ্গে আগের বিশ্বাস এবং ইসলাম ধর্ম পালন করে। এদের বলা হয় মেইতেই পানগন (Meitei Pangon) বা মণিপুরী মুসলমান। মণিপুরীদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে ধর্মবিশ্বাস, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জীবনের বিশেষ বিশেষ সন্ধিক্ষণে, যেমন জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে ইত্যাদিতে তারা নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও প্রচলিত আচারাদি পালন করে থাকে।

শাহাবুদ্দিন শুভ

১. বাংলাদেশের মণিপুরী সম্প্রদায় , মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বিডিনিউজ ২৪.কম
২. বাংলাদেশের মণিপুরী, এ কে শেরাম, জালালাবাদ এসোসিয়েশন কর্তৃক প্রকাশিত স্মারক ২০১৭, প্রকাশ কাল মার্চ ২০১৭
৩. বাংলা পিডিয়া
৪. বাংলাদেশের লোকজ সাংস্কৃতিক গ্রন্থমালা- মৌলভীবাজার , প্রকাশক বাংলা একাডেমী, প্রকাশ কাল জুন ২০১৪

About শাহাবুদ্দিন শুভ

Read All Posts By শাহাবুদ্দিন শুভ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *