বানিয়াচং উপজেলা Baniachong Upazila : (হবিগঞ্জ জেলা) আয়তন: ৪৮২.২৫ বর্গ কিমি। অবস্থান: ২৪°২১´ থেকে ২৪°৪১´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১°১৩´ থেকে ৯১°৩০´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। সীমানা: উত্তরে দিরাই, শাল্লা ও আজমিরিগঞ্জ উপজেলা, দক্ষিণে হবিগঞ্জ সদর ও লাখাই উপজেলা, পূর্বে হবিগঞ্জ সদর ও নবীগঞ্জ উপজেলা, পশ্চিমে আজমিরিগঞ্জ, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলা। বানিয়াচং গ্রাম এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম গ্রাম হিসেবে পরিচিত। প্রশাসন থানা গঠিত হয় ১৭৯০ সালে। বর্তমানে এটি একটি উপজেলা।
বানিয়াচং উপজেলার নামকরণ : ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জানুয়ারি বানিয়াচং থানা প্রতিষ্ঠিত হওয়া বানিয়াচং গ্রাম এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম গ্রাম হিসেবে পরিচিত। এর নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন জনশ্রুতি আছে যেমন স্বর্ণকারদেরকে আঞ্চলিক ভাষায় বানিয়া বলা হতো। বানিয়া জনগোষ্ঠীর নাম হতে এলাকার নাম হয় বানিয়াচং। কথিত হয়, এক সময় ‘বানিয়া’ নামে পরিচিত স্বর্ণকারদের একটি বিশেষ সম্প্রদায় এখানে বাস করতো। সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, অস্ট্রিক ভাষায় চং এবং গারো ভাষা সাং শব্দের অর্থ দেশ। বানিয়া এবং চং শব্দ সমন্বয়ে বানিয়াচং। বানিয়াচং শব্দের অর্থ বানিয়া বা স্বর্ণকারদের দেশ।
বানিয়াচং নামকরণের আর একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে। সেটি বিনায়ে জং প্রবাদ নামে পরিচিত। ‘বিনায়ে জং’ শব্দের অর্থ যুদ্ধক্ষেত্র। আলোচ্য এলাকাটি ছিল ভৌগোলিক ভাবে একটি অত্যন্ত কৌশলগত এলাকা। অধিকন্তু সম্পদেও ছিল ঐশ্বর্য্যময়। তাই এলাকাটি নিয়ে বিভিন্ন শাসকদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগে থাকতো। এজন্য এলাকাটির নাম হয় বিনায়েজং। বিনায়েজং শব্দ হতে ক্রম পরিবর্তনের মাধ্যমে এলাকাটির নাম বানিয়াচং-এ স্থিত হয়।
লাউড় রাজ্যে বানিয়াচং
“সিলেট জেলার হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলার অধিকাংশ স্থান নিয়ে এই রাজ্য গঠিত ছিল। এটি ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে অনুমান করা হয়। একটি বৃহৎ রাজ্য ছিল। এই রাজ্যে কে কখন রাজত্ব করেন তাহার নির্ভরযোগ্য বিবরণ পাওয়া যায় না। জনৈক কেশবকে লাউড় রাজ্যের পূর্ব পুরুষ বলে চিহ্নিত করা হয়। কেশব মিশ্র ভাগ্যন্নোয়ন কল্পে কনৌজ হতে এই দেশে (লাউড়) এসে বসবাস করতে থাকেন। কেশবচন্দ্র হতে তদীয় বংশধর রাজা গোবিন্দচন্দ্রকে তাহার দশম পুরুষ হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এই গোবিন্দচন্দ্র মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতঃ রাজা হাবিব খান নামে অভিহিত হন। জনশ্রুতি অনুসারে লাউড়ের এক রাজার নাম ছিল ভগদত্ত। অদ্যাপি লাউড়ের পাহাড়ে এবং দীনারপুরের সদরঘাটে রাজা ভগদত্তের বাড়ির ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান থাকার কথা কিংবদন্তি সূত্রে প্রচলিত আছে। ভগদত্তের পরে নবর, জোন, মাধুলী ও প্রেমবর্ধন নামক কয়েকজন রাজার নাম সিলেট ডিস্ট্রিট গেজেটিয়ারে উল্লেখিত হইয়াছে। (পৃষ্ঠা-৬০) দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে প্রেমবর্ধন লাউড়ে রাজত্ব করেন বলিয়া অনুমান করা হয়। কেশব মিশ্রের বংশধর জনৈক রামনাথের ৩ পুত্রের মধ্যে প্রথম পুত্র জগন্নাথপুরে এবং তৃতীয় পুত্র বানিয়াচং এ অবস্থান করেন। জগন্নাথপুরের দরবারসিংহ স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করত দরবার খান নামে অভিহিত হন। লাউড় রাজার কোন বংশধর না থাকায় তিনি এটি দখল করে নেন। দরবার খানের মৃত্যুর পর তৎকালীন বানিয়াচং এর রাজা গোবিন্দ সিংহ লাউড় রাজ্য দখল করতে প্রয়াস পান। এই বিষয়ে তৎকালীন নবাবের নিকট নালিশ করলে গোবিন্দ সিংহকে রাজধানী দিল্লিতে ডেকে পাঠান হয়। সেখানে তিনি স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং হাবিব খান নাম ধারণ করেন। এটি ১৫৬৬ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা বলিয়া উল্লেখ পাওয়া যায়। ইবনে খালদুনের হিসাব মতে এক পুরুষে তেত্রিশ বৎসর ধরিলে হাবিব খান হতে কেশব মিশ্র পর্যন্ত ১০ পুরুষে ৩৩০ বৎসর হয়। এতে কেশব মিশ্রের সময় ১৪৬৬-৩৩০=১১৩০ খ্রিস্টাব্দে পাওয়া যায়। এতোধিক বিবরণ নির্ভরযোগ্য কোন গ্রন্থে পাওয়া যায় না। জগন্নাথপুরের কোন কোন পরিবার অদ্যাপি জগন্নাথ রাজ্যের অধিপতি বলিয়া দাবি করেন। পরবর্তীকালে বানিয়াচংয়ের পরিবার সমগ্র লাউড় রাজ্যের মালিক হন। ১৭৪৬ খ্রিস্টাব্দে খাসিয়ারা লাউড় পুড়াইয়া ফেলে। ফলে বহু লোক লাউড় ছেড়ে বানিয়াচংয়ে চলে যায়। আবিদ রাজা বানিয়াচংয়ে বসবাস করেন। বি. সি. এলেনের সিলেট ড্রিষ্টিক্ট গেজেটিয়ার তাকে হাবিব খানের পুত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে।”
খাসিয়া আক্রমণ ও লাউড় ধ্বংস
হবিব খাঁর দুই পুত্র। জ্যেষ্ঠের নাম মজলিস আলম খাঁ।৩ আলমের পুত্র আনওয়ার খাঁ। ইহার সময়ে এক আকস্মিক উৎপাতে লাউড় নগর বিধ্বস্ত ও পরিত্যক্ত হয়। খাসিয়া পর্ব্বতের কয়েকটি রাজা (সর্দ্দার) একত্র মিলিত হয়ে লাউড় আক্রমণ করে। পঙ্গপালের ন্যায় বন্য খাসিয়া সৈন্য পৰ্ব্বত হতে আপতিত হল, মূহূর্ত্তে পথ ঘাট ছাইয়া ফেলে। যে অল্পসংখ্যক রাজসৈন্য ছিল, নিমেষের মধ্যে তাঁদের চিহ্ন লোপ পেল। অধিবাসীদিগণে যে যেখানে পারল, প্রাণ নিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে পালাল। তাহাদের পশুবৎ অত্যাচারে অবশিষ্ট বালবৃদ্ধ সকলেই নিহত হল, লাউড় একরূপ জনশূন্য হয়ে পড়ল।
বানিয়াচং এর তৎকালীন সময়ের পরগণা সমূহ
১। বংশীকুন্ডা
২। রণদিঘা।
৩। সেলবরষ।
81 সুখাইড়।
৫। বেতাল।
৬। পলাশ।
৭। লক্ষণছিরি (লক্ষণশ্রী)
৮। চামতলা।
৯। পাগলা।
১০। দুহালিয়া।
১১। বাজুজাতুয়া।
১২। সিংহচাপড়।
১৩। সফাহার। (সফি নগর?)
১৪। সিকসোণাইতা। (সোণাউতা)
১৫। আতুয়াজান।
১৬। আটগাও।
১৭। কুবাজপুর।
১৮। জোয়ার বাণিয়াচঙ্গ ।
১৯। কসবা বাণিয়াচঙ্গ
২০। জলসুখা।
২১ বিথঙ্গল।
২২। জোয়ানশাহী।
২৩। মুড়াকইড়। (মুড়াকড়ি)
২৪। কুরশা।
২৫। জনতরি (যন্ত্রী)।
২৬। হাউলি সোণাইতা।
২৭। সতর সতী।
২৮। পাইকুড়া
বানিয়াচং উপজেলা
পৌরসভা | ইউনিয়ন | মৌজা | গ্রাম | জনসংখ্যা শহর | জনসংখ্যা গ্রাম | (প্রতি বর্গ কিমি) |
– | ১৫ | ২৩৭ | ৩৫৯ | ২৮৫০৬ | ৩০৪০২৪ | ৬৯০ |
বানিয়চং উপজেলা শহর
আয়তন (বর্গকিমি) | মৌজা | লোকসংখ্যা | ঘনত্ব(প্রতি বর্গ কিমি) | শিক্ষার হার |
১৩.২৯ | ৮ | ২৮৫০৬ | ২১৪৫ | ৪৪.৭ |
উপজেলার ইউনিয়ন সমূহের তথ্য
ইউনিয়নের নাম ও জিও কোড | আয়তন (একর) | পুরুষ | মহিলা | শিক্ষার হার (%) |
উত্তর-পশ্চিম বানিয়াচং ১২ | ৫১৯৩ | ১২৬৬৮ ৪০.১ | ১২৬৬৮ | ৪০.১ |
উত্তর-পূর্ব বানিয়াচং ০৬ | ৮৪৬৩ | ৬৬৬৯ | ৬৫৩৪ | ৪০.৭ |
সুবিদপুর ৯৪ | ৮৫৯৩ | ৭৭১৩ | ৭৮১৬ | ৪০.৯ |
কাগাপাশা ৪৪ | ১৭৮২৮ | ১২৮১৮ | ১২৯৮২ | ২৭.৩ |
খাগাউড়া ৫০ | ৭০২৭ | ১১৯৪৮ | ১২৪৪৩ | ৩৩.৭ |
দক্ষিণ-পশ্চিম বানিয়াচং ২৫ | ৬০৪৯ | ১১৭৮৭ | ১২৬৭৭ | ৩৫.৯ |
দক্ষিণ-পূর্ব বানিয়াচং ১৮ | ৪০০৭ | ১৩০৯৯ | ১৪০৯৮ | ৩৪.২ |
দৌলতপুর ৩৭ | ৬৮১৬ | ১৪৯৭৬ | ১৫২২৮ | ৪৩.৫ |
পুখড়া ৮২ | ১০৪৭৫ | ১২৪৪২ | ১২৫৩০ | ৪০.৫ |
পাইলারকান্দি ৭৫ | ৫৭৭৮ | ৮৯২৩ | ৮৮৩১ | ২৭.৯ |
বাড়ৈউড়ি ৩১ | ৮১৩৮ | ৯৪৪৬ | ১০১৪৬ | ৩২.১ |
মকরমপুর ৫৬ | ৮৪৩৩ | ১১৯৫৮ | ১২৪৫২ | ২৮.৩ |
মান্দারি ৬৩ | ৮৯১৯ | ৯৫১১ | ৯২৬৭ | ২৮.৬ |
মুরাদপুর ৬৯ | ৬০১৭ | ৭০৭৫ | ৭১৬১ | ২০.২ |
সুজাতপুর ৮৮ | ৮৭২৬ | ৯২৫৮ | ৯২০৯ | ৩৬.৪ |
বদল পুরের যুদ্ধ : ১৯৭১ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে জগৎজ্যোতির নেতৃত্বে দাস কোম্পানি যুক্তিঙ্গয়ারগাঁও থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে বিতাড়িত করার পরিকল্পনা করে। এজন্য দলটি ২” মর্টার, এলএমজি ও অন্যান্য অস্ত্র সহযোগে রওনা হয় শাল্লার পথে। কিন্তু তাঁরা ১৭ অক্টোবর শেষরাতে ঘুঙ্গিয়ারগাঁও অভিযান বাতিল করে বানিয়াচংয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে বানিয়াচংয়ের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। পথে ঘুঙ্গিয়ারগাঁওয়ে এক দল পাকিস্তানি সৈন্যের সঙ্গে তাঁদের গুলি বিনিময় হয়। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সৈন্যদলটিকে ধাওয়া করেন। সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা বদলপুরের কাছাকাছি আসলে সেখানে একটি খালের মধ্যে পাহারারত একদল রাজাকার তাঁদের সামনে পড়লে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের আক্রমণ করেন। পথিমধ্যে ঘুঙ্গিয়ারগাঁওয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের যে দলটি মুক্তিযোদ্ধাদের ধাওয়া খেয়েছিল তারাও গুলি বিনিময়ের শব্দ শুনে সতর্ক হয়ে যায়। গুলির শব্দ লক্ষ্য করে তারা এগিয়ে আসে। পাশাপাশি আজমিরীগঞ্জ ও মারকুলি থেকে আসা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সম্মিলিত একটি দল একসাথে আক্রমণ চালিয়ে বিল ও নদীর মধ্যবর্তী স্থলভাগে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ফেলে। এক পর্যায়ে জগৎজ্যোতি পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে তাড়া করে সম্মুখে অগ্রসর হলে তিনি মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তিনি তাঁর মর্টার ও এলএমজি নিয়ে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হন। অবরুদ্ধ অবস্থায় সারা দিন তিনি ঠেকিয়ে রাখেন পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে। তাঁর কৌশলগত আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে সরে যেতে সক্ষম হয়। ১৮ অক্টোবর রাতে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ছোড়া গুলির আঘাতে শহিদ হন। এই আক্রমণে জগৎজ্যোতির নির্ভুল নিশানায় ১২জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। জগৎজ্যোতিকে ভারতীয় অফিসার মনে করে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাঁকে আজমিরীগঞ্জ নিয়ে যায়। আজমিরীগঞ্জ বাজারের একটি রাস্তার পাশে পিলারের সাথে পেরেকে বিদ্ধ করে ঝুলিয়ে রাখে জগৎজ্যোতি দাসের মৃতদেহ। জগৎজ্যোতি দাসকে পরবর্তীকালে ‘বীরবিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। বদলপুরের এই যুদ্ধে জগৎজ্যোতির সহযোদ্ধারা ছিলেন গোপেশ চন্দ্র দাস (তিনিও এই যুদ্ধে শহিদ হন), ইলিয়াস, মুতিউর রহমান, আইয়ুব আলী, আবদুল মজিদ, নিত্যানন্দ, বিজয় দাস, ইদ্রিস আলী, আবু সুফিয়ান, সুবল চন্দ্র চৌধুরী প্রমুখ।
বানিয়াচং থানার হলদারপুর গ্রামে বোমবর্ষণ : ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল দুপুরে বানিয়াচং থানার ৭ নম্বর বরইউড়ি ইউনিয়নের অন্তর্গত হলদারপুর গ্রামের একটি বাড়িতে বহু লোকের সমাগমে এক আনন্দঘন পরিবেশে বিবাহ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছিল। মধ্যাহ্নভোজের পর বাড়ির সামনের মাঠে লাঠিখেলার আয়োজন করে কনে পক্ষ। উত্তেজনাপূর্ণ লাঠিখেলা উপভোগের জন্য সেখানে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। কিছুক্ষণ পর প্রচণ্ড আওয়াজ করে নিচু দিয়ে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একটি স্যাবর জেট গ্রামের উপর দিয়ে আকাশে কয়েক বার ঘুরপাক করল। উপস্থিত লোকজন কৌতূহল-বশত বিমানের দিকে তাকিয়ে এটাকে একটি স্বাভাবিক বিষয় বলেই ধরে নিলেন। ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেল বিবাহ উৎসব ও বিমান উড়ার বিষয়টিও তাঁরা ভুলে গেলেন। তারপর ১৯ এপ্রিল দুপুর প্রায় ২টায় হলদারপুর গ্রামবাসী নামাজ ও মধ্যাহ্নভোজের পর নিজ নিজ বাড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। হঠাৎ ২টি জঙ্গি বিমান খুব নিচু দিয়ে গ্রামের পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে দ্রুতগতিতে উড়ে যাওয়ার সময় কিছু কাগজ ছিটিয়ে দিল। তারপর বিমান ২টি পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে নিচু হয়ে প্রচণ্ড বেগে উড়ে এসে কয়েকটি রকেট নিক্ষেপ করে এবং সেই সঙ্গে প্রচণ্ড গুলি বর্ষণ করতে থাকে। বোমা বর্ষণে গ্রামের মক্তব উড়ে যায় আর অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত হয় সমগ্র গ্রাম। চারদিকে মানুষের আর্ত চিৎকার। ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রামের এদিকে-ওদিকে পড়ে থাকে অসংখ্য মৃতদেহ। গ্রামবাসীরা হঠাৎ বিমান থেকে বোমা বর্ষণের কারণ বুঝতে পারছিলেন না। তাঁরা মৃতদেহগুলো জড়ো করে দাফনের ব্যবস্থা করেন এবং আহতদেরকে রিকশা বা ভ্যানে করে থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রেরণ করেন। সেই বর্বরোচিত বিমান আক্রমণে সেদিন হলদারপুরের ৯জন নিরীহ গ্রামবাসী শহিদ ও ৩২জন আহত হন।
শিক্ষার হার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড় হার ৩৪.৭%; পুরুষ ৩৫.২%, মহিলা ৩৪.১%।
উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: এল আর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় (১৮৯৬), নাগুরা ফার্ম উচ্চ বিদ্যালয়, বানিয়াচং সিনিয়র মাদ্রাসা।
বানিয়াচং উপজেলার উল্লেখ্য যোগ্য হাট-বাজার : বানিয়াচং উপজেলার হাট-বাজারগুলো নিন্মরূপ: বানিয়চং বড়বাজার, ৫/৬ নং বাজার (গরুর হাট), বিথঙ্গল বাজার, কুমড়ী দূর্গাপুর বাজার, সুজাতপুর বাজার, ইকরাম বাজার, আলীগঞ্জ বাজার, আনন্দ বাজার, দৌলতপুর চক বাজার, আদর্শবাজার, মুরাদপুর বাজার
স্বাস্থ্যকেন্দ্র : উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ১, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ১৫, পরিরবার পরিকল্পনা কেন্দ্র ১২, কমিউনিটি ক্লিনিক ২, প্রাইভেট ক্লিনিক ৩, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র ১, মাতৃসদন ১, দাতব্য চিকিৎসালয় ২, স্বাস্থ্য উপকেন্দ্র ৫, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ২, পশু চিকিৎসালয় ১।
বিথঙ্গল আখড়া : বানিয়াচং উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১২ কিঃ মিঃ দক্ষিণ পশ্চিমে হাওড় পাড়ে বিথঙ্গল গ্রামে আখড়াটি অবস্থিত। যা বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের জন্য অন্যতম তীর্থস্থান। এ আখড়ার প্রতিষ্ঠাতা রামকৃষ্ণ গোস্বামী উপমহাদেশের বিভিন্ন তীর্থস্থান সফর শেষে ষোড়শ শতাব্দীতে ঐ স্থানে আখড়াটি প্রতিষ্ঠিত করেন। এ আখড়ায় ১২০জন বৈষ্ণবের জন্য ১২০টি কক্ষ রয়েছে। উল্লেখ্য প্রায় ৫শ বছর পূর্বে ত্রিপুরার রাজা উচ্চবানন্দ মানিক্য বাহাদুর প্রাচীন নির্মাণ কৌশল সমৃদ্ধ দুইটি ভবন নির্মাণ করে দেন এবং মানিক্য বাহাদুর ও তাঁর স্ত্রী ঐ আখড়ায় প্রায়ই এসে অবস্থান করে ধর্মকর্ম করতেন। এ ভবনগুলো সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসের পথে। বর্তমানে আখড়ার প্রতিষ্ঠাতা রামকৃষ্ণ গোস্বামীর সমাধিস্থলে আধুনিক স্বপত্য শৈলীর একটি ভবন তৈরি করে দিয়েছেন জনৈক ব্যক্তি। এ আখড়াটি ঘিরে কার্তিক মাসের শেষ দিন ভোলা সংক্রান্তি উপলক্ষে কীর্তন হয়। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দোল পূর্ণিমার পাঁচ দিন পর পঞ্চম দোল উৎসব উদযাপিত হয়। চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে ভেড়া মোহনা নদীর ঘাটে ভক্তগণ পুণ্যস্নান করেন এবং বারুণী মেলা বসে। এ ছাড়া আষাঢ় মাসের ২য় সপ্তাহে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। আখড়ার প্রতিটি উৎসবে ৫ থেকে ১০ হাজার ভক্তের সমাগম ঘটে। ঐ আখড়ায় দর্শনীয় বস’র মধ্যে রয়েছে ২৫মন ওজনের শ্বেত পাথরের চৌকি (খাট), পিতলের তৈরি সিংহাসন, প্রাচীন কারুকার্য সমৃদ্ধ রথ এবং রৌপ্য পাখি ও সোনার মুকুট।
কিভাবে যাওয়া যায়: শুকনো মৌসুমে হবিগঞ্জ কামড়াপুর ব্রীজ হতে জীপ যোগে সুজাতপুর হয়ে নৌকোযোগে অথবা পায়ে হেটে বর্ষা মৌসুমে হবিগঞ্জ কালার ডুবা থেকে নৌকা অথবা বানিয়াচং আদর্শ বাজার হতে নৌকাযোগে
অবস্থান: পৈলারকান্দি ইউনিয়নের বিথঙ্গল গ্রামে
হাবিব খাঁ’র রাজবাড়ি : বানিয়াচংয়ের একটি দর্শনীয় স্থান রাজা হাবিব খাঁ কর্তৃক নির্মিত রাজবাড়ি। দৃষ্টিনন্দন রাজবাড়ির সেই জৌলুস এখন না থাকলেও এর ধ্বংসাবশেষ প্রমাণ করে একদিন এখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলো বিশাল রাজবাড়ি। প্রাসাদের পাশেই আছে কয়েকটি মসৃণ পাথরের স্তম্ভ। লোকজন এগুলোকে ‘হব্যা’ ‘গোমা’র দাড়া-গুটি বলে আখ্যায়িত করে। জনশ্রুতি আছে, হব্যা ও গোমা দু’ভাই দীঘির পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ে দাঁড়িয়ে স্তম্ভগুলো নিয়ে খেলা করতো
রামনাথ বিশ্বাসের ভিটা: বানিয়াচং-এ রামনাথ বিশ্বাসের ভিটাও দেখে আসতে পারেন। বাংলার প্রথম ভূ পর্যটক রামনাথ বিশ্বাস সাইকেলে তিপ্পান্ন, পায়ে হেঁটে সাত, রেলগাড়িতে দুই এবং জাহাজে পঁচিশ হাজার মাইল-সব মিলিয়ে ৮৭ হাজার মাইল ভ্রমণ করেছেন। ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের জন্ম ১৮৯৪ সালে বানিয়াচং- এর বিদ্যাভূষণপাড়ায়। তার বসতঘরটি এখানো টিকে আছে।
লেখা : শাহাবুদ্দিন শুভ
তথ্যসূত্র :
১. সিলেটের ইতিহাস , সংগ্রহ সম্পাদনায় কমল চৌধুরী, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা ২০৯
২. শ্রী হট্টের ইতিবৃত্ত পূর্বাংশ – অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি, প্রকাশক – মোস্তফা সেলিম, উৎস প্রকাশন ২০১৭, পৃষ্ঠা ৩৯৪-৩৯৫
৩.মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস, – সিলেট, লে. কর্ণেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির, বীরপ্রতীক, বাংলা একাডেমী, এপ্রিল ২০১৮ পৃষ্ঠা ১৩৪,১৩৫, ২২৫,২২৬
৪. বাংলাদেমের স্বাধীনতা যুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৪, মার্চ ২০০৬, পৃষ্ঠা ২৩৯-২৪৯
৫. শিলহটের হতিহাস, মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন, উৎস প্রকাশন ২০০৬, পৃষ্ঠা ১৮৩-১৮৮
৬. বাংলাদেশের জেলা ও উপজেলার নামকরণের ইতিহাস, ড. মোহাম্মদ আমীন, শোভা প্রকাশ ২০১৮
৭. উইকিপিডিয়া
৮. তথ্য বাতায়ন
৯. বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা – হবিগঞ্জ
১০. সিলেট বিভাগের প্রশাসন ও ভূমি ব্যবস্থা ,মোঃ: হাফিজুর রহমান ভূঁইয়া, সেপ্টেম্বর ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ৭১,
১১. জনসংখ্যা ২০০১ সালের শুমারী অনুযায়ী
১২. আদমশুমারি রিপোর্ট ২০০১, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো; বানিয়চং উপজেলার মাঠ পর্যায়ের প্রতিবেদন ২০০৭।
১৩. বানিয়চং উপজেলার মানচিত্রের ছবি বাংলাপিডিয়া থেকে নেওয়া।
১৪. বাংলাদেশ ভ্রমণসঙ্গী : মোস্তফা সেলিম, উৎসব প্রকাশন, মার্চ ২০১১, পৃষ্ঠা ২১৯,২২০,২২১